কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে (কুবি) চট্টগ্রাম স্টুডেন্টস ওয়েলফেয়ার এসোসিয়েশনের সভাপতি পদকে কেন্দ্র করে তুলকালাম কাণ্ড ঘটেছে। এক ছাত্রলীগ নেতার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে সভাপতি হওয়ার জন্য রাজনৈতিক ক্ষমতার জোর দেখিয়ে তিনি অনুষ্ঠিতব্য নবীন বরণ অনুষ্ঠানের ব্যানার ছিঁড়ে ফেলেছেন, এসোসিয়েশনের বর্তমান সভাপতি তারেককে জনসম্মুখে অপমান ও মারধরের হুমকি দিয়েছেন এবং সভাপতি-সম্পাদককে দিয়ে সংগঠনের সাদা প্যাডে স্বাক্ষর নিয়েছেন। অভিযুক্ত ছাত্রলীগ নেতার নাম খায়রুল বাসার সাকিব ওরফে কে বি সাকিব। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হল শাখা ছাত্রলীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক।
এদিকে কে বি সাকিব কর্তৃক হেনস্থার শিকার হয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে সংগঠনটির সভাপতি তারেকুল ইসলাম আত্মহত্যার ঘোষণা দিয়ে ক্যাম্পাস ছাড়েন। পরে পুলিশের ও তিশা বাস কর্তৃপক্ষের সহায়তায় তাকে চট্টগ্রামের অলংকার এলাকা থেকে উদ্ধার করে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়।
শুক্রবার (১২ আগস্ট) বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনের ৪১১ নম্বর কক্ষে চিটাগাং স্টুডেন্টস ওয়েলফেয়ার এসোসিয়েশনের নবীন বরণ অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার আগমুহূর্তে এ ঘটনা ঘটে।
প্রত্যক্ষদর্শী ও ওই সংগঠনের সদস্যদের সূত্রে জানা যায়, কে বি সাকিব বঙ্গবন্ধু হলের ছাত্রলীগের কর্মীদের নিয়ে অনুষ্ঠানে এসে দাওয়াত না দেয়ার অভিযোগ তুলে ব্যানার ছিঁড়ে অনুষ্ঠান পণ্ড করার চেষ্টা করেন। পূর্বঘোষিত অনুষ্ঠান যেন নষ্ট না হয়ে সেজন্য কে বি সাকিবের হেনস্থার মুখে তাকে বারবার বুঝানোর চেষ্টা করে তারেক। বিষয়টি তখন শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি ইলিয়াস হোসেন সবুজকে জানানো হলে তিনিও কে বি সাকিবকে ফোন দিয়ে বুঝানোর চেষ্টা করলেও সাকিব তা মানেনি। এরপর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মো. রেজাউল ইসলাম মাজেদ মিমাংসা করে দিতে ঘটনাস্থলে আসেন। কে বি সাকিবের চাপে তার উপস্থিতিতে সেখানেই বাধ্য হয়ে এসোসিয়েশনের সভাপতি তারেক ও সাধারণ সম্পাদক আকবরকে স্বাক্ষর করতে হয় সংগঠনের সাদা প্যাডে।
স্বাক্ষর শেষে সেখান থেকে হলে চলে যান তারেক। তার কয়েকজন বন্ধু জানান, হলে এসে এই অপমান নিতে না পেরে ভেঙে পরে তারেক। তারপর ব্যাগ গুছিয়ে চট্টগ্রামের বাসায় যাবেন জানিয়ে হল থেকে বের হয়ে যান। এর কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি আত্মহত্যা করবেন জানিয়ে ফেসবুকে নিজের টাইমলাইন থেকে একটি পোস্ট দেয়া হয়।
ওই পোস্টে লেখা হয়, ‘আমার মৃত্যুর জন্য যে বা যারা দায়ী হইত তাদের বিচার দুনিয়ার এই নামধারী বিচারকদের কাছে পাবো না। আল্লাহর আদালতে দেখা হবে। আল্লাহ তুমি আমার মা বাপরে দেইখা রাইখো। আল্লাহ তুমি জালিম বিচারকদের বিচার কইরো।’
তিনি আরো লিখেন, ‘মা তুমি জানো এর আগেও খালেদ সাইফুল্লাহ খুন হয়েছিলো। উনার মা বিচার পাই নাই। মা আমার জন্য কাঁদিও না। মা তোমায় মিস করবো। মা তুমি জানো ওরা আমাকে বলেছে সিগনেচার করে দিতে। আমি করে দিছি। আমি ঝামেলা করি নাই। মা জানো আমি অনেক রাগী ছিলাম। এখন অভিমানী। মা মিস ইউ। আব্বু, আপু নাদিয়া সরি।’
এই পোস্টের পর থেকে তার খোঁজে নামেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর, পুলিশ, সাংবাদিক, শাখা ছাত্রলীগ ও তার বন্ধুরা। একপর্যায়ে খোঁজ মেলে তিনি কুমিল্লার পদুয়ার বাজার বিশ্বরোড থেকে তিশা বাসে চড়ে চট্টগ্রামের অলংকার গিয়ে নেমেছেন। পরে পুলিশের সহায়তায় তিশা বাস কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে চট্টগ্রামের অলংকারে তাকে তার পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়।
এ ব্যাপারে কুমিল্লা কোটবাড়ি পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ রিয়াজ উদ্দিন জানান, ‘স্ট্যাটাসের সাথে সাথে তাকে খুঁজতে বের হয়ে পদুয়ার বাজার বিশ্বরোড এসে তিশা প্লাস বাস কাউন্টারের সিসিটিভি ফুটেজ চেক করে তাকে শনাক্ত করি। তিনি বর্তমানে চট্টগ্রামে পরিবারের কাছে আছেন।’
এদিকে, সংগঠন ও অনুষ্ঠানের সভাপতির এমন আত্মহত্যার পোস্ট দেয়ার পরও থেমে যায়নি অনুষ্ঠান। সভাপতির চেয়ার শূন্য রেখেই চলে তা। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অধ্যাপক ও এক সহযোগী অধ্যাপক। এছাড়াও কুমিল্লাস্থ চট্টগ্রাম সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও দুই পুলিশ কর্মকর্তা।
সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক আকবর হোসেন বলেন, ‘আমরা অনেক পরিশ্রম করে অনুষ্ঠান সাজাই, কিন্তু সভাপতি হতে চাওয়া কে বি সাকিব হল থেকে কয়েজনকে নিয়ে এসে ব্যানার ছিঁড়ে ফেলে আর অনুষ্ঠান বাতিল ঘোষণা করে। ইলিয়াস ভাই তাকে ফোনে বুঝানোর চেষ্টা করলেও সে ভাইয়ের কথা মানে না। এরপর মাজেদ ভাই বললো অনুষ্ঠান আগে চালাও পরে সমাধান হবে। তবুও সে মানে না, সে তারেককে অপমান করে আর কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করতে বলে। অনুষ্ঠান নষ্ট না হওয়ার স্বার্থে আমরা স্বাক্ষর করি। কিন্তু তারেক বিষয়টি মেনে নিতে পারেনি। এবং সে অনেক বেশি ইমোশনাল হয়ে পড়ে। তারই আয়োজিত অনুষ্ঠানে জুনিয়রদের সামনে সে অপমানিত হলো। এজন্য সে আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।’
এ ব্যাপারে সংগঠনের সভাপতি তারেকুল ইসলামের বক্তব্য এখনও পাওয়া সম্ভব হয়নি।
তবে তারেককে মানসিক হেনস্থা ও ব্যানার ছিঁড়ে ফেলে অনুষ্ঠানে বাধা দেয়ার বিষয় অস্বীকার করে খায়রুল বাসার সাকিব বলেন, ‘এমন কোনো ঘটনা ঘটেনি। অনুষ্ঠান নিয়ে সবার সাথে কথা বলা উচিত। কিন্তু তা তারা করেনি। তাই প্রশ্ন করা হয়েছে যে আমাদের সবাইকে কেন ডাকা হল না। এখানে আমাদের সংগঠনের (ছাত্রলীগ) কোনো পোলাপান যায়নি। সবাই চট্টগ্রাম স্টুডেন্ট'স ওয়েলফেয়ার এসোসিয়েশনের শিক্ষার্থীরা গিয়েছে।’
সংগঠনের উপদেষ্টা মার্কেটিং বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মঈনুল হাসান বলেন, ‘অনুষ্ঠান চলার ব্যাপারে কমিটি জানে। আমি বলতে পারবো না। আমি তার স্ট্যাটাসের বিষয়টা জানা মাত্রই তাকে খুঁজতে গেছি।’
এই ঘটনার ব্যাপারে শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি ইলিয়াস হোসেন সবুজ বলেন, ‘আমি ক্যাম্পাসে ছিলাম না বলেই সে একটু বেশি ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ করতে পেরেছে। আমি থাকলে সে এমন আচরণ করতে পারতো না। সে যা করেছে তা সম্পূর্ণ অনধিকার চর্চা। ছাত্রলীগের পদ ও ক্ষমতা ব্যবহার করে যা করেছে তা নিঃসন্দেহে অন্যায়। আগামীকাল আমরা এর কারন জানতে চাইবো।
কারণ সন্তোষজনক না হলে তার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিব। সংগঠন (ছাত্রলীগ) কাউকে অধিকার দেয়নি মানুষের আঞ্চলিক সংগঠনে গিয়ে পেশিশক্তি ব্যবহার করার জন্য।’
এ ব্যাপারে শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মো. রেজাউল ইসলাম মাজেদ বলেন, ‘আমি ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেছি। সবাইকে বলেছি আপাতত অনুষ্ঠান শেষ হোক। অনুষ্ঠান শেষে এ বিষয়ে আলোচনা করা যাবে।’
এই ঘটনার ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর কাজী ওমর সিদ্দিকী বলেন, ‘বিষয়টি জানার সাথে সাথেই পুলিশকে অবগত করে আমি তাকে খু্ঁজতে বের হই। পদুয়ার বাজার বিশ্বরোডে পুলিশ, শাখা ছাত্রলীগের সেক্রেটারি মাজেদ, প্রক্টরিয়াল বডি ও সাংবাদিক সবাই একসাথে বিভিন্ন বাস কাউন্টারের যাত্রীদের লিস্ট ও সিসিটিভি ফুটেজ দেখে তার সন্ধান পাই।’
উল্লেখ্য, চলতি বছরের ১৭ মার্চ ডেকোরেশনের বাঁশের ওপর প্রস্রাব করতে নিষেধ করায় স্থানীয় এক যুবককে মেরে রক্তাক্ত করেছিল খায়রুল বাসার সাকিব, সেদিনও তিনি মাদকাসক্ত ছিলেন বলে অভিযোগ উঠেছিল। এছাড়া গত ২৫ জুলাই কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনজন সাংবাদিকের ফোন কেড়ে নিয়ে প্রমাণ লোপাট ও শাসানোর ঘটনা ঘটিয়েছেন তিনি। তার বিরুদ্ধে সাংবাদিকদের হল থেকে বের করাসহ বিস্তর অভিযোগ রয়েছে।
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: