দেশের প্রথম নারী উপাচার্য ও দুই মেয়াদে দায়িত্ব পালন করা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. ফারজানা ইসলামের মেয়াদ শেষ হয় গত ১ মার্চ। সেদিনই পরবর্তী উপাচার্য নিয়োগ না হওয়া পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভিসি (শিক্ষা) অধ্যাপক ড. মো. নুরুল আলম কে নিজ দায়িত্বের অতিরিক্ত ভাইস চ্যান্সেলরের দৈনন্দিন রুটিন দায়িত্ব প্রদান করে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
তবে নিয়মিত উপাচার্য না থাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক সহ বিভিন্ন কাজে স্থবিরতা বিরাজ করছে বলে জানা যায়। এতে চরম ভোগান্তিতে পড়েছে শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্ট সকলেই।
এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় হাজারখানেক গুরুত্বপূর্ণ ফাইল এখনো সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. ফারজানা ইসলামের বাসায় জমা আছে বলে জানা যায়। রেজিস্ট্রার দপ্তর, হিসাব বিভাগ, উন্নয়ন প্রকল্পের দপ্তর, শিক্ষকদের পদোন্নতির ফাইল, ইঞ্জিনিয়ার দপ্তরসহ গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরের পুরোনো এসব ফাইল ফারজানা ইসলাম কুক্ষিগত করে রেখেছেন বলে অভিযোগ করেছেন সংশ্লিষ্টরা। এসবের বিষয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত উপ-উপাচার্যকেও অভিহিত করা হয়নি। ফলে অধ্যাপক ফারজানা ইসলাম এসব ফাইলে ব্যাকডেট দিয়ে সিগনেচার করে ব্যক্তিস্বার্থ হাসিল করতে পারেন বলে আশংকা করছেন অনেকেই।
২য় মেয়াদ শেষ হলেও অধ্যাপক ফারজানা ইসলাম পুনরায় নিয়োগ পেতে জোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন এবং প্রধানমন্ত্রী ১২ মার্চ দেশে ফিরে তাকে আবারও দায়িত্ব দেবেন বলে শিক্ষকদের নিকট নিজের আত্মবিশ্বাস প্রদর্শন করছেন তিনি। ৩য় মেয়াদে নিয়োগপ্রাপ্ত হওয়ার প্রচেষ্টা ও ফারজানা ইসলামের এমন মনোভাবকে নজিরবিহীন বলছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক শিক্ষার্থীরা।
ইতিপূর্বে, গত ২ মার্চ ফারজানা ইসলাম ভিসি পদ থেকে বিদায় নেওয়ার পরে শিক্ষার্থীরা আনন্দ মিছিল করেছে। অধিকাংশ শিক্ষক-শিক্ষার্থী তাকে আর এ পদে ক্যাম্পাসে দেখতে চান না বলে অভিমত ব্যক্ত করেছেন। সেদিন তার দূর্নীতির বিচারের দাবিতেও বিক্ষোভ মিছিল করেন শিক্ষার্থীরা।
এদিকে উপাচার্যের পদ শূন্য হওয়ায় নতুন উপাচার্য কে হচ্ছেন এটা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে চলছে নানা জল্পনা কল্পনা। উপাচার্য হতে দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছেন অনেক প্রভাবশালী শিক্ষক।
উপাচার্য হওয়ার দৌড়ে রয়েছেন পরিসংখ্যান বিভাগের সাবেক শিক্ষক অধ্যাপক এম এ মতিন। তিনি বিভাগের সভাপতি, বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট ও সিন্ডিকেট সদস্য, উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) এবং ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আওয়ামীপন্হী শিক্ষকদের নেতৃত্বেও ছিলেন অধ্যাপক মতিন। এছাড়াও তিনি জাবি শিক্ষক সমিতির তিন বারের নির্বাচিত সভাপতি, বঙ্গবন্ধু শিক্ষক পরিষদের প্রতিষ্ঠাকালীন যুগ্ন আহবায়ক ও বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ফেডারেশনের মহাসচিবের দায়িত্ব পালন করেছেন।
বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালনকালে তিনি জাবি শিক্ষক সমিতির সংবিধান প্রণয়ন, চাকরিবিধি ও সিনেটের কার্যবিধি প্রণয়ণের মত গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছেন। এছাড়া শিক্ষার্থীবান্ধব বিভিন্ন উদ্যেগ গ্রহণ করেছিলেন অধ্যাপক মতিন। সৎ, নিষ্ঠাবান ও সর্বজনশ্রদ্ধেয় শিক্ষক হিসেবে তার পরিচিতি রয়েছে।
উপাচার্যের রুটিন দায়িত্ব প্রাপ্ত প্রো-ভিসি অধ্যাপক মো. নুরুল আলমও উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার সম্ভবনা রয়েছে। পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের এ অধ্যাপক জাবি শিক্ষক সমিতির সভাপতি, গাণিতিক ও পদার্থ বিষয়ক অনুষদের ডিন, সিনেট ও সিন্ডিকেট সদস্য হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছিলেন।
উপাচার্য হতে চেষ্টা চালাচ্ছেন জাবির অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক ও সম্প্রতি উপ-উপাচার্যের (প্রশাসন) দায়িত্ব শেষ করা অধ্যাপক মো. আমির হোসেন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজাবিজ্ঞান অনুষদের ডিন, সিনেট ও সিন্ডিকেট সদস্য এবং ‘বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী প্রগতিশীল শিক্ষক সমাজ’-এর সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন।
সম্প্রতি উপ-উপাচার্যের (প্রশাসন) দায়িত্ব পাওয়া ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের অধ্যাপক শেখ মো. মনজুরুল হকও উপাচার্য হতে দৌড়ঝাপ চালাচ্ছেন। এর আগে তিনি সমাজাবিজ্ঞান ও আইন অনুষদের ডিন ও কোষাধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেছেন। তবে তিনি শারীরিকভাবে অসুস্থ ও প্রায় অফিসে অনুপস্থিত থাকেন বলে জানা গেছে।
এছাড়া তার বিরুদ্ধেও পূর্বে বামপন্থী ও বিএনপিপন্থী রাজনীতিতে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। এক সময় তিনি আওয়ামী লীগ বিরোধী প্লাটফর্ম লেখক শিবিরের হয়ে কাজ করতেন বলে অভিযোগ রয়েছে। ২০০২ সালে অনুষ্ঠিত সমাজাবিজ্ঞান অনুষদের ডিন পদে বিএনপিপন্থী শিক্ষকদের ব্যানারে সাদা দলের পক্ষে নির্বাচনে অংশ নিয়ে জয়লাভ করেন তিনি। সম্প্রতি তিনি প্রভাবশালী এক নিকটাত্মীয়ের মাধ্যমকে কাজে লাগিয়ে উপ-উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পান। একই মাধ্যমকে কাজে লাগিয়েই পুনরায় উপাচার্য হতে চেষ্টা চালাচ্ছেন বলে জানা যায়।
উপাচার্য হতে চেষ্টা চালাচ্ছেন গাণিতিক ও পদার্থ বিদ্যাবিষয়ক অনুষদের ডিন ও পরিসংখ্যান বিভাগের অধ্যাপক অজিত কুমার মজুমদার। তিনি নিজ স্বার্থে দল পরিবর্তনকারী হিসেবে শিক্ষক মহলে পরিচিত। বর্তমান উপাচার্যের বিরুদ্ধে আন্দোলনের সময় তিনি উপাচার্যবিরোধী আওয়ামীপন্থী শিক্ষকদের সংগঠনের ব্যানারে আন্দোলন করেন। তবে পরে উপাচার্যের বলয়ে যোগ দেন। অধ্যাপক অজিতের বারংবার দলবদলের কারণে সরকার ও প্রশাসন বেশ বিব্রত বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
উপাচার্য হওয়ায় চেষ্টায় আছেন সম্প্রতি দায়িত্বপ্রাপ্ত কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক রাশেদা আখতার। এর আগে তিনি সমাজাবিজ্ঞান অনুষদের ডিন ও যৌন নিপীড়ন বিরোধী সেলের প্রধানের দায়িত্ব পালন করেছেন। উচ্চ পদস্থ আমলাদের মাধ্যমে তিনিও তদবির চালিয়ে যাচ্ছেন বলে জানা গেছে।
এছাড়াও পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক আবদুল মান্নান চৌধুরী, প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক সুফি মোস্তাফিজুর রহমান ও প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক আবদুল জব্বার হাওলাদারও সম্ভাব্য উপাচার্যের দৌড়ে রয়েছেন বলা জানা যায়।
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: