চিকিৎসাধীন স্বামীর বেডের পাশে বসে আহাজারি করছেন নিহত শিশুটির মা মিনারা বেগম। পুলিশের গুলিতে নিহত শিশু সুরাইয়া বেগমের মা মিনারা বেগমের কান্না থামছেই না।
রানীশংকৈল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসাধীন স্বামীর বিছানার নিচে বসে অনবরত কান্না করছেন তিনি। আত্মীয়স্বজন কাউকে দেখলেই ডুকরে ডুকরে কেঁদে উঠছেন। পাগলের প্রলাপের মতো বলছেন, ‘আমার মা তো সকাল হলেই খেলাধুলা করত, ঘুরে বেড়াত। এ নির্বাচন আমার মাকে কেড়ে নিল। এই ভোট আমার নিষ্পাপ শিশুটিকে কেড়ে নিল।’
প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হলে মিনারা বেগম কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘নির্বাচন শেষে আমি ভাংবাড়ি ব্রিজের পাশের বাড়িতে আমার মেয়েকে নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম। ব্রিজের কাছে খুব হট্টগোল শুরু হলে আমি আরেকটু সরে দাঁড়াই। এ সময় পুলিশ ও সাধারণ মানুষের মধ্যে সংঘর্ষে লেগে গেলে আমি একটি বাড়ির দরজায় গিয়ে দাঁড়াই। একপর্যায়ে পুলিশ গোলাগুলি শুরু করে। আচমকা একটি গুলি এসে আমার মেয়ে সুরাইয়া বেগমের মাথায় লাগে। সঙ্গে সঙ্গেই আমি চিৎকার দিয়ে মেয়েকে নিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ি। ঘটনাস্থলেই আমার মেয়ে মারা যায়।’
মিনারা বেগম আরও বলেন, ‘আমার দুই মেয়ে ও এক ছেলের মধ্যে সুরাইয়া সবার ছোট। বড় মেয়ে সুমাইয়ার বয়স আট বছর। সে মীরডাঙ্গী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্রী। ছেলে মেরাজুল ইসলাম সবার বড়। সে মীরডাঙ্গী উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ৬ষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র। আমরা মীরডাঙ্গী ঈদগাহ বস্তি আশ্রয়ণ প্রকল্পের বাসিন্দা। মূলত আমরা স্বামী স্ত্রী মিলে ভাংবাড়ি ভিএফ নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভোট দিতে গিয়েছিলাম। ভোট শেষে ফলাফল শুনে আসার পথে এ দুর্ঘটনা ঘটে।’
শিশুটির বাবা বাদশাহ জানান, ঘটনাস্থলে তিনিও ছিলেন। পুলিশের টিয়ারশেল ও গুলির ভয়ে তিনি দৌড়ে পালান। একপর্যায়ে তিনি শুনতে পান তাঁর ছোট মেয়ে পুলিশের গুলিতে মারা গেছেন। পরে তিনি কাছে এসে দেখেন তাঁর মেয়ের মাথা ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে মরদেহ পড়ে আছে। তা দেখে তিনি তাৎক্ষণিক জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন।
শিশুটির বাবা হাসপাতালের বেডে শুয়ে শুয়ে প্রতিবেদককে বলেন, ‘গতকাল বুধবার রাতে জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। আজ বৃহস্পতিবার সকালে উঠে সবার প্রথম আপনার সঙ্গেই কথা বলছি। আপনাকে বোঝাতে পারব না আমার ভেতরে কী হচ্ছে। এভাবে পুলিশ আমার শিশুটিকে গুলি করে মেরে দিল, আর তা আমাদের চেয়ে চেয়ে দেখতে হলো। এ যেন অসহ্য যন্ত্রণা। বারবার মায়ের মুখ আমার চোখের সামনে ভাসছে। তাকে যে আমি ভুলতে পারছি না। কি করে যে আমার মিষ্টি মায়ের মুখখানা ভুলব তা ভাবতে পারছি না। আল্লাহ আমার মাকে যেন পরপারে সুখে রাখেন।’
উল্লেখ্য, গতকাল বুধবার ভোটগ্রহণ শেষে তালা প্রতীকের প্রার্থী বাবুল প্রার্থীকে ইউপি সদস্য হিসেবে জয়ী ঘোষণা করেন প্রিসাইডিং কর্মকর্তা খতিবর রহমান। ফলাফল ঘোষণার পর মোরগ প্রতীকের প্রার্থী খালেদুর রহমান ও ফুটবল প্রার্থী আজাদ পুনরায় ভোটগণনার জন্য সংশ্লিষ্ট প্রশাসনিক দায়িত্বরত কর্মকর্তা ও প্রিসাইডিং কর্মকর্তাকে অনুরোধ করেন। এ সময় তাঁরা অনুরোধ রাখার আশ্বাস দিলেও হঠাৎ করেই নির্বাচনী সামগ্রী নিয়ে কেন্দ্র থেকে চলে আসতে চাইলে পরাজিত প্রার্থীর সমর্থকেরা তাঁদের গাড়ি আটকে দেন। এ সময় পুলিশ প্রথমে টিয়ারশেল পরে এলোপাতাড়ি গুলি ছোড়ে। সেই গুলিতে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায় শিশু সুরাইয়া।
এ ঘটনার পর তাৎক্ষণিকভাবে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়লে উত্তেজিত জনতা পুলিশের ওপর আক্রমণ করে। এ সময় পুলিশের একটি মাইক্রোসহ দুজন পুলিশকে বেধড়ক মারধর করেন উত্তেজিত জনতা। পরে উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) ইন্দ্রজিৎ সাহার নেতৃত্বে রানীশংকৈল থানার ওসিসহ দুই গাড়ি বিজিবি ও পুলিশ সদস্য গিয়ে তাঁদের উদ্ধার করেন।
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: