আহারে! আহারে! আল্লাহ্রে আল্লাহ্রে! আপা নাই, আপা নাই! একদল স্ত্রীলোক চিৎকার করতে করতে জনসভা প্রাঙ্গণ থেকে দৌঁড়ে এদিক-সেদিক যাচ্ছে।
ঘটনাটি ২০০৪ সনের ২১ আগস্ট। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের প্রথম দিকের ছাত্র, অর্থাৎ মাত্র প্রথম বর্ষ শেষ করে দ্বিতীয় বর্ষে ক্লাস করি। ছাত্রলীগের সমস্ত মিছিল-মিটিংয়ে যোগদান করি। আমি ব্যক্তিগতভাবে দেশরত্ন শেখ হাসিনা ও প্রয়াত মেয়র হানিফ ভাইয়ের বক্তব্যের ভক্ত। সেই সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ টিএসসি থেকে মিছিল নিয়ে বঙ্গবন্ধু এ্যাভিনিউর আওয়ামী লীগের পার্টি অফিসে যোগদান করতো। আমিও কম-বেশি সেই মিছিলের সারথী হতাম। সেদিন দুপুরের পরে মধুর কেন্টিন থেকে জানতে পারলাম, ছাত্রলীগ মিছিল নিয়ে পার্টি অফিসে যাবে না, যে যার ইচ্ছে মতো সমাবেশে যাবে।
আমি সিদ্ধান্ত নিলাম মিটিংয়ে যাব। আমার পকেটে ৩৫ টাকা আছে। দুপুরে খাইনি। একটা রিক্সা ভাড়া নিলাম ২৫ টাকায়। রিক্সা মিছিলে অংশগ্রহণকারী জনস্রোতের চাপে প্রেস ক্লাবের পর আর যেতে পারলো না। আমি রিক্সা থেকে নেমে গেলাম। গুলিস্তান পার্টি অফিসে যেতে বাকী পথ মিছিলের তালে তালে চলে গেলাম।
পার্টি অফিসের সামনে বাটার জুতার দোকানের কাছাকাছি ছাত্রলীগের সিনিয়র নেতারা দাঁড়িয়ে আছে। আমি তাদের সাথে কতোক্ষণ দাঁড়িয়ে বিভিন্ন আওয়ামী লীগের নেতাদের বক্তব্য শুনলাম। বক্তব্য শোনার এক পর্যায়ে সিলেটের সুনামগঞ্জের বড় ভাই দোলন চৌধুরী আমাকে ফোন দেয়। আমার হাতে রবি নাম্বারের একটা এ্যালকাটেল সেট। দোলন ভাইর সাথে মাথা নিচু করে কথা বলতেছি। কথা শেষ করে মাথা উঠিয়ে দেখি ছাত্রলীগের বড় ভাইয়েরা কেউ সেখানে দাঁড়ানো নেই। কখন তারা সেখান থেকে সরে গেছে তা টের পাইনি। আশে-পাশে ছাত্রলীগের কেউ নেই, আর সমাবেশে প্রচণ্ড মানুষের ভীড়। সেখানে আমার কেমন যেন দাঁড়িয়ে থাকতে মন চাচ্ছে না। সমাবেশে লোকের সংখ্যা কেমন হয়েছে, তা দেখতে ইচ্ছে করছে। আমি লোকের ভীড় থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করলে অনেকে আমাকে বাধা দেয়। আমি বাধা উপেক্ষা করে সেখান থেকে বের হয়ে আসি। হানিফ ভাই ভরাট কণ্ঠে বলতেছেন-দেশরত্ন শেখ হাসিনা আমাদের জনসভা স্থলে কিছুক্ষণের মধ্যে পৌঁছে যাবেন, আপনারা আপাকে আসার সুযোগ করে দিবেন এবং কিছুক্ষণ পর আপা চলে এলেন।
আমি গুলিস্তানের গোলাপ শাহ'র মাজার ঘুরে পীর ইয়ামেনি মার্কেটের সামনে দিয়ে বাইতুল মোকাররমের পাশ দিয়ে স্টেডিয়াম হয়ে পার্টি অফিসের পূর্ব পাশ দিয়ে জনসভার স্থলের দিকে যাচ্ছি। আমি যখন ঘুরে ঘুরে লোক দেখতেছিলাম তখন আপা বক্তৃতা করছিলেন। আপা বক্তব্যে শেষের দিকে বললেন- "আপনারা মিছিল নিয়ে এগিয়ে যান, আমি আপনাদের পিছনে পিছনে আসছি।" আমি তখন পার্টি অফিসের রাজ্জাকের দোকানের নিকটবর্তী। সময় সম্ভবত ৫ঃ২০ মিনিট। এমন সময় দুটি তারের সংস্পর্শে যেমন কিন কিন শব্দ হয়, ঠিক তেমন এমন একটা শব্দ হলো। পরপর বিস্ফোরণ। তাকিয়ে দেখি আপার গাড়ির পাশে ধোঁয়ার কুণ্ডলী (সন্ত্রাসী তারেকের প্লান দেশরত্ন শেখ হাসিনাকে হত্যা করা। সন্ত্রাসী যদি এলোপাতাড়ি গ্রেনেড নিক্ষেপ করতো তাহলে শত শত আওয়ামী লীগের লোক মারা যেতো)।
মহিলারা জুতা বগলবদ্ধ করে দৌঁড়াচ্ছে আর চিৎকার করে বলতেছে- আহারে!আহারে! আপা নাই! আমিও জোরে একটা চিৎকার দিলাম। ঘটনাস্থলে দাঁড়িয়ে ৭-৮ গ্রেনেড বিস্ফোরণের আওয়াজ শুনতে পেলাম। আপার চারিদিকে ধোঁয়া আর ধোঁয়া, আপাকে দেখা যাচ্ছে না। ওখানে যে ট্রাক আছে তাও বুঝা যাচ্ছে না। আমি কাঁদতে কাঁদতে স্টেডিয়ামের দিকে দৌঁড় দেই। আমি ঢাকা শহর তেমন চিনতাম না। ২০০১ সনে ঢাকা এসেছি। রাজনীতিতে তখন অনভিজ্ঞ।
সেই সময় স্টেডিয়ামের পাশে সিডি বিক্রি করা হতো। দৌঁড়ে গিয়ে সিডি দোকানের মধ্যে পড়ে গেলাম। পায়ের একটা স্যান্ডেল সিডি দোকানে আটকে গেল। অনেক কষ্টে স্যান্ডেলটা তুললাম। স্যান্ডেল পায়ে দিলাম। কি করবো বুঝতে পারছি না। পল্টল ময়দানে একটা বাসে আগুন জ্বলছে। আমি পল্টনের মসজিদে ঢুকলাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সভাপতি দেলোয়ার ভাইকে ফোন দিয়ে ভয়াবহ বিষয়টি জানালাম। মাদারীপুর জেলা ছাত্রলীগের সেক্রেটারি ইলিয়াস আহমেদকে ফোন দিয়ে ঘটনাটা অবহিত করলাম। আমি ফোন করতেছিলাম মসজিদের বারান্দায় দাঁড়িয়ে। বাহিরে পুলিশের আনাগোনা। সকলে মসজিদের ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করছে। আমাকে হুজুর টাইপের এক লোক বললো- তুই ফোন দিয়া মানুষরে জানাইয়া দিছোস, তোরে মসজিদের ভেতর ঢুকতে দিমু না। উনাকে ঠেলে আমি মসজিদের ভেতর প্রবেশ করি। সেইদিন আমার কাছে মসজিদও নিরাপদ মনে হয়নি।
দোলন ভাইয়ের বড় ভাই দীপক চৌধুরী। দীপকদা বড় মাপের সাংবাদিক। কয়েকটা বই লিখেছেন। দোলন ভাইকে ফোন করে বললাম, এমন এমন ঘটনা, দাদার মাধ্যমে একটু জানেন তো, আপা বেঁচে আছে কিনা। দোলন ভাই বললো- আপা বেঁচে আছেন। ঘটনার দশ মিনিট পরে আপার বেঁচে থাকার বিষয়টি আমি জানতে পারি।
চারিদিকে আগুন জ্বলছে ও পুলিশের আনাগোনা। আমি মসজিদ থেকে দৌঁড় দিয়ে বের হয়ে যাই। মসজিদের ভেতর হুজুরের ভয়। ভালো লাগছে না। আপাকে আল্লাহ বাঁচিয়ে রাখে, ভবিষ্যতেও রাখবেন।
লেখকঃ মেহেদি হাসান
সাংগঠনিক সম্পাদক, বাংলাদেশ আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগ
সাবেক সভাপতি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ।
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: