একবার ঘর ছাড়লে আর ঘরে ফেরা যায়না,জানেন?

সময় ট্রিবিউন | ১৭ এপ্রিল ২০২২, ০৩:৫১

প্রতীকী ছবি

আমি যখন ঢাকা ইউনিভার্সিটির স্টুডেন্ট তখন হলে সিট দেয়া হত মেধা তালিকার ভিত্তিতে। সিরিয়ালের শুরুর দিকে থাকায় প্রথম কলেই ডাক পাই আমি। একটা নামকাওয়াস্তে ভাইভা টাইপ হয়। মিস বলেন, 'মেয়ে তুমি তো হলে থাকবা না। বাসায় চলে যাবা ভার্সিটির বাসে করে'। আমি মুচকি হেসে বলি, 'যা জ্যাম মিস রাস্তায়! হলে না থাকলে সকাল ৮টার পরীক্ষা দেয়া/ক্লাস ধরা মুশকিল হয়ে যাবে'।

যেদিন হলে উঠব, আব্বু এলো সাথে। কি লাগবে কিছুই জানি না। একটা তোশক আর কিছু জামা কাপড় নিয়ে হলের গেটে আমাকে নামিয়ে দিল আব্বু। এর ভেতরে আর যেতে দিবে না তাকে। আজীবন বাসায় থাকা মেয়ে আমি। একটা রাতও বাইরে থাকিনি। আব্বু কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। আমিও। চোখে জমছে জলের সমুদ্র। কি মুশকিল!

আশপাশ দিয়ে এত মেয়ে যাচ্ছে,আসছে কেউ তো কাঁদছে না! সবাই নতুন পাওয়া স্বাধীনতার আনন্দে মশগুল। আর এর মাঝে আমরা বাবা-মেয়ে অপ্রস্তুত হয়ে দাঁড়িয়ে। আব্বু একটা ঢোক গিলে মাথায় হাত রেখে বলল, ঠিক আছে মা। সাবধানে থেকো। কিছু লাগলে ফোন দিও। আর যখন বেশি খারাপ লাগবে, ক্লাস কম থাকবে বাসায় চলে আসবা। নাকি এখনি বাসায় নিয়ে যাব?

আমি কান্নার দমকে কিচ্ছু বলতে পারলাম না। আমার মনে হল আমি আজীবনের জন্য পর হয়ে যাচ্ছি। আমার বাসার ঘর-বারান্দা আর আমার থাকবে না। নিজের ঘরে আজকের পর থেকে আমি অতিথি হয়ে যাব।

অনেক রকম বন্ধু হবে আমার, আড্ডা হবে, সন্ধ্যার পর গেটের বাইরে ফুচকা খাব, কে জানে হয়ত একটা প্রেম হবে গল্পের মত, নীলক্ষেতের সব বইয়ের দোকান আমার হাতের নাগালে, রয়েলের তেহারি খাব, শ্যাডোর লেবুর শরবত হাতে নিয়ে দেশ-সমাজ নিয়ে কথা বলব, এক পা বাড়ালে টিএসসি এসব চিন্তা তখন একটুও মাথায় কাজ করছিল না। লাফাতে লাফাতে হলে থাকতে এসে আমি কাঁদতে কাঁদতে মরে যাচ্ছিলাম।

আজ এতকাল পর এসব মনে পড়ে হাসি পায় আমার।একবার ঘর ছাড়লে আর কখনো ঘরে ফেরা যায় না এই সত্যিটা তখন জানতাম না অথবা হয়ত মানতে কষ্ট হচ্ছিল। অথচ জীবন মানেই পরিবর্তনকে মেনে নেয়া। কমফোর্ট জোনের বাইরে না গেলে তো গ্রোথ আসে না। সেদিনের লেখা পড়ে ডাইনিং টেবিলে আমার ফাঁকা হয়ে যাওয়া চেয়ার ভরতে অনেকে ভাইকে বিয়ে করাতে বলছিলেন। খুব একচোট হেসে নিলাম আমরা দুই ভাই বোন।

আমার ফেলে আসা শূন্যতা কেউ কোনদিন ভরাতে পারবেনা। এমনকি আমিও পারবনা। আমি নিজে তো আর সেই 'আমি' টা নেই। এই যে মায়ের কাছে থাকতে যাই কদিনের জন্য কোন কিছুই আর আগের মত লাগে না। আমার খোলা বারান্দার সামনে আকাশ ঢেকে দেয়া বিল্ডিং উঠছে। কার্জন থেকে কিনে নেয়া বাচ্চা ক্যাকটাস বড় টবে সংসার পেতেছে। মায়ের বারান্দায় নতুন একটা নাম না জানা গাছ। একই বাসা, একই স্কয়ার ফিট আছে। তবু কি অচেনা লাগে!

আমি আর ওখানে থাকি না, তবু আমার বিছানা টানটান করে পাতা থাকে। আমার ছেড়ে আসা কাপড়চোপড় যত্নে উঠে যায় ওয়ারড্রবে। কেবল ২০১১ এর এক সকালে ঘর ছাড়া মেয়েটা আর ওখানে থাকে না। কোথাওই থাকে না আদতে।

জীবনে একের পর এক স্টেপ পাড়ি দিয়ে সে এখন অন্য মানুষ। এই যে আমরা একের পর এক পেছনে ফেলে আসি প্রিয় ঘর,মন, জানালা এটাই হয়ত বেঁচে থাকা। নতুন ঘর হয় আমাদের। নতুন স্বপ্নেরা ডালপালা মেলে। তবু শেকড় রয়ে যায় সেই ছেড়ে আসা ঘরটায়। মাঝে মাঝে টান পড়লে ব্যথা হলে তার নাম আমরা দিই 'নস্টালজিয়া'...

এই গল্পগুলো মন খারাপের না। জীবনের। জীবন মানে তো কেবল পাতা উল্টে যাওয়া। তার ফাঁকে কোন এক চৈত্রের দুপুরে সময় হলে, খানিকক্ষণ আগের পাতাগুলোয় হাত বুলানো আর ভাবা, 'আমাদের গেছে যে দিন,একেবারেই কি গেছে... কিছুই কি নেই বাকি?'

ফেসবুক থেকে নেওয়া



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


জনপ্রিয় খবর