মোহাম্মদ আখলাক:
বিশ্ব ভেটেরিনারি দিবস আজ। সারা বিশ্বের প্রাণী সেবায় নিয়োজিত চিকিৎসকদের জন্য বিশেষ একটি দিন। প্রতি বছর এপ্রিলের শেষ শনিবার সারাবিশ্বে যথাযথ মর্যাদায় দিনটি পালিত হয়। প্রাণী চিকিৎসকরাই সাধারণত ভেটেরিনারিয়ান নামে পরিচিত। একটি দেশের পুষ্টি বিশেষ করে প্রোটিন, আমিষের চাহিদার ভারসাম্য নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন এই ভেটেরিনারিয়ানরা।
সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, বিনামূল্যে প্রাণীর চিকিৎসা ও পরামর্শ প্রদান, টিকাদান কর্মসূচির মতো আয়োজনের মধ্য দিয়ে বিশ্বের প্রতিটি দেশ পালন করে বিশ্ব ভেটেরিনারি দিবস। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য বিষয়- "Veterinarian response to the COVID-19 crisis."
প্রতিপাদ্যের দিকে আলোকপাত করলে দেখা যায়, ভেটেরিনারিয়ানরা কেবল প্রাণীর স্বাস্থ্য সুরক্ষায় অবদান রাখছে তা নয়, তারা কোভিড-১৯ এর বিরুদ্ধে যুদ্ধে অক্লান্তভাবে কাজ করে যাচ্ছে। ভেটেরিনারি ক্লিনিকগুলো তাদের ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম- ফেস শিল্ড, পিপিই, ভেন্টিলেটরের মতো প্রয়োজনীয় সামগ্রী, পিসিআর মেশিন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে তুলে দিয়েছে।
বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএলআরআই) এর ল্যাবে ও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেটেরিনারি অনুষদের ল্যাবে করোনাভাইরাস শনাক্তকরণের কাজ চলছে। ভেটেরিনারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের পিসিআর মেশিন, জনবল বিভিন্ন মেডিকেলে দিয়ে সহায়তা করেছে।
মহামারিতে বিশ্বে ভেটেরিনারিয়ানদের বীরত্বগাথা রচিত হয়েছে। ফাইজারের কোভিড ভ্যাক্সিন আবিষ্কার টিমের প্রধান ড. আলবার্ট বোরলা একজন ভেটেরিনারিয়ান। পিপিই নিরাপদে পুনঃব্যবহারের কৌশলের আবিষ্কারক এফ. হ্যাঙ্কেনসনও ভেটেরিনারিয়ান।
আমাদের দেশের ভেটেরিনারিয়ান বিজন কুমার শীলের কথা বলতে হয়। সারা বিশ্ব যখন করোনা ভাইরাসের মহামারিতে দিশেহারা, তখন তিনি করোনা ভাইরাস শনাক্তকরণের র্যাপিড টেস্ট কিট উদ্ভাবন করে মানুষের পাশে এসে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছেন।
বিজন কুমার শীল একজন আন্তর্জাতিক মানের বাংলাদেশি ভাইরোলজিস্ট, ভ্যাকসিনোলজিস্ট এবং ভেটেরিনারিয়ান বিজ্ঞানী। এর আগে সিঙ্গাপুরে দীর্ঘদিন অবস্থান করা এই ভেটেরিনারি বিজ্ঞানী সেখানে সার্স করোনা ভাইরাস-১ এবং ডেঙ্গু ভাইরাসের র্যাপিড টেস্ট কিট উদ্ভাবন করেও অনেক আলোচিত হয়েছিলেন। এছাড়া তিনি গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেটেরিনারি অনুষদের অনুজীব বিভাগের একজন শিক্ষক ও এশিয়ার বৃহৎ চিকিৎসা গবেষণা কেন্দ্র ‘গণ স্বাস্থ্য কেন্দ্র’র একজন গবেষক।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) এর তথ্য মতে, সারাবিশ্বে যত ভাইরাসঘটিত রোগ আছে তার শতকরা ৭০ ভাগের উৎপত্তি বন্যপ্রাণী থেকে। এ ছাড়া ডব্লিউএইচও বলছে, জীবন্ত বন্যপ্রাণী ধরা ও বিক্রি যদি চলতে থাকে তবে পৃথিবীতে সামনে আরও ভাইরাসঘটিত রোগের সৃষ্টি হবে।
বিভিন্ন প্রাণী থেকে মানুষে ছড়ানো রোগগুলোকে বলা হয় ‘জুনোটিক ডিজিজ'। এসব রোগের অন্যতম কারণ বন্য জীবজন্তু ও পশু-পাখির সঙ্গে মানুষের সংস্পর্শ বৃদ্ধি পাওয়া।
বিশ্বজুড়ে এখন আতঙ্কের নাম কোভিড-১৯, মহামারি এ ভাইরাসটি ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে চীনের উহান শহরের একটি বন্যপ্রাণীর বাজার থেকে ছড়িয়ে পড়ে। বাদুড়ের শরীর থেকে করোনাভাইরাস ছড়িয়েছে বলে মনে করেন মহামারি বিশেষজ্ঞরা। কয়েক বছর আগে বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়া নিপাহ, সার্স, ইবোলা ভাইরাসের জন্যও বাদুড়কেই দায়ী করা হয়।
সোয়াইন ফ্লু, নিপাহ, ইবোলা, মার্স, সার্স, র্যাবিস, অ্যানথ্রাক্স, বোভিন টিবি, মারবুর্গ, লেপটোসিরোসিস এবং বর্তমান কোভিড-১৯ এই সকল বড় বড় মহামারির উৎস প্রাণী। এসব মহামারিতে অতীতে লাখ লাখ মানুষের মৃত্যুর রেকর্ড রয়েছে।
মানবকল্যাণে ভেটেরিনারিয়ানরা এইসব রোগের উপর গবেষণা করছে। পৃথিবীর প্রাণিকুলের স্বাস্থ্য সুরক্ষিত না থাকলে মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষিত থাকবে না। মানুষের সুস্বাস্থ্যের জন্য প্রাণিকুলের সুস্থতা প্রয়োজন সবার আগে।
এজন্য প্রাণী স্বাস্থ্য সুরক্ষা এবং পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করতে বিশ্ব ভেটেরিনারি অ্যাসোসিয়েশন (ডব্লিওভিএ) যৌথভাবে ওয়ার্ল্ড অর্গানাইজেশন ফর এনিমেল হেলথ (ওআইই), বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থ্যা (ডব্লিওএইচও) এবং ফুড এন্ড এগ্রিকালচার অর্গানাইজেশন (এফএও) এর সঙ্গে সারাবিশ্বে কাজ করে যাচ্ছে।
১৮৬৩ সালে এডিনবার্গ ভেটেরিনারি কলেজের প্রফেসর জন গ্যামেজ সারাবিশ্বের ভেটেরিনারিয়ানদের ইউরোপে একটি সভাতে আমন্ত্রণ জানান। পরবর্তীতে এই সভাটিই প্রথম আন্তর্জাতিক ভেটেরিনারি কংগ্রেস নামে পরিচিতি লাভ করে। মুলত ওই সভার মূল উদ্দেশ্য ছিলো এপিজুটিক রোগ ও এর প্রতিরোধ ব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা করা। এই কংগ্রেসটি বিশ্ব ভেটেরিনারি কংগ্রেস হিসেবে রুপ লাভ করে। ১৯০৬ সালে ৮ম বিশ্ব ভেটেরিনারি কংগ্রেস এ বিশ্ব ভেটেরিনারিয়ান নেতৃবৃন্দ একটি কমিটি গঠন করে যার মূল উদ্দেশ্য ছিলো নিজেদের মধ্যে সাংগঠনিক যোগাযোগ রক্ষা করা।
সুইডেনের রাজধানী স্টকহোমে আয়োজিত ১৫ তম বিশ্ব কংগ্রেস এ স্থায়ী কমিটির নেতৃবৃন্দ একটি আন্তর্জাতিক সংগঠন গঠন ও সংবিধান প্রনয়নের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। ১৯৫৯সালে স্পেনের মাদ্রিদে অনুষ্ঠেয় কংগ্রেসে বিশ্ব ভেটেরিনারি এসোসিয়েশন গঠিত হয়। প্রাণি স্বাস্থ্য ও সুরক্ষা, এবং পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্য সুরক্ষা করাই ছিলো মূল উদ্দেশ্য। এরই ধারাবাহিকতায় বিশ্ব ভেটেরিনারি এসোসিয়েশন বর্তমানে ওয়ার্ল্ড অরগানাইজেশন ফর এনিমেল হেলথ (ওআইই), বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থ্যা (ডব্লিওএইচও), ফুড এন্ড এগ্রিকালচার অর্গানাইজেশন(এফএও) এর সাথে এক হয়ে সারা বিশ্বে কাজ করছে ।
২০০১ সালে বিশ্ব ভেটেরিনারি এসোসিয়েশন, ভেটেরিনারি পেশার সাথে কর্মরত সকল ভেটেরিনারিয়ানদের জন্য একটি বিশেষ দিন আয়োজনের প্রস্তাব গ্রহন করে। যা প্রতি বছরের এপ্রিল মাসের শেষ শনিবার। এর মূল লক্ষ্য হলো ভেটেরিনারি পেশাকে সারা বিশ্বের মানুষের কাছে পৌছে দেওয়া এবং প্রানি ও মানুষের উন্নয়নে কাজ করা, পরিবেশের উন্নয়ন, খাদ্য নিরাপত্তা এবং প্রানি পরিবহন ও কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিতকরনে ভুমিকা রাখা। বিশ্বের সকল সদস্য দেশের বিশ্ব ভেটেরিনারি দিবস উৎযাপনের উপর ভিত্তি করে এওয়ার্ড ও দিয়ে থাকে বিশ্ব ভেটেরিনারি এসোসিয়েশন।
বাংলাদেশে ২০০৮ সালে প্রথম দি ভেট এক্সিকিউটিভ আয়োজন করে বিশ্ব ভেটেরিনারি দিবসটি। বর্তমানে বাংলাদেশ ভেটেরিনারি এসোসিয়েশন (বিভিএ), দি ভেট এক্সিকিউটিভ, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর, বাংলাদেশ ভেটেরিনারি ছাত্র সমিতি যৌথভাবে দিনটি নানা আয়োজনের সঙ্গে উদযাপন করে থাকে।
প্রাচীনকাল থেকেই ভেটেরিনারি শিক্ষা সারা বিশ্বের মানবকল্যাণে গুরুত্বপুর্ণ ভূমিকা রেখে আসছে। খ্রিষ্টপূর্ব ২৫০০ সন থেকে চীন দেশের অধিবাসীরা প্রাণীর চিকিৎসাসমূহ প্যাপাইরাস নামক গাছের পাতায় লিখে রাখতেন। ভেটেরিনারিয়ানরা অনেক আগে থেকেই ইবোলা, সোয়াইন ফ্লু, বার্ড ফ্লু, র্যাবিস, ফুট অ্যান্ড মাউথ ডিজিজের মতো বিভিন্ন জুনোটিক ডিজিস নিয়ে কাজ করছে। বিভিন্ন রোগ নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি, রোগপ্রতিষেধক টিকা এবং প্রতিকারের উপায় বের করতে ভেটেরিনারিয়াদের অবদান অনস্বীকার্য। এ পর্যন্ত যতগুলো টিকা আবিষ্কৃত হয়েছে তার সবই প্রাণিসম্পদের ওপরই পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফল।
ভেটেরিনারি শিক্ষার ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায় ক্লয়ডি বারজিলেট নামক এক ব্যক্তি ফ্রান্সের লিয়ন শহরে ১৭৬১ সালে পৃথিবীর সর্বপ্রথম ভেটেরিনারি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। লিয়নে ভেটেরিনারি স্কুল প্রতিষ্ঠার পর থেকেই ১৭৬৬ সালে মধ্যেই বারলিন, মিউনিখ, মিলান, ভিয়েনা, কোপেনহেগেনে ভেটেরিনারি স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৭৯১ সালে ইংল্যান্ডের প্রথম ভেটেরিনারি স্কুল রয়েল কলেজ অব ভেটেরিনারি সার্জন প্রতিষ্ঠিত হয়। এ ধারাবাহিকতায় আমেরিকাতে ১৮৭৯ সালে প্রথম ভেটেরিনারি স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়।
ভারতীয় উপমহাদেশে আধুনিক ভেটেরিনারি পেশার যাত্রা শুরু হয় ১৭৭৪ সালে ‘ঘোড়া প্রজনন খামার' প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। পরবর্তীতে দক্ষ ভেটেরিনারিয়ান তৈরির উদ্দেশ্যে ১৮৭৭ সালে ভারতের বাবুগড়ে প্রথম ভেটেরিনারি কলেজ স্থাপন করা হয়।
বাংলাদেশে ভেটেরিনারি শিক্ষার গোড়াপত্তন কুমিল্লাতে, ১৯৪৭ সালে ৭ আগস্ট কুমিল্লাতে প্রথম ৩ বছরমেয়াদি ডিপ্লোমা কোর্স চালু হয়। পরে ১৯৫০ সালে কলেজটি ঢাকার তেজগাঁও স্থানান্তরিত হয় ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ৫ বছরমেয়াদি পশুপালন ডিগ্রি চালু করা হয়।
১৯৬২ সালে ময়মনসিংহে সবর্প্রথম ইস্ট পাকিস্থান অ্যাগ্রিকালচার ইউনিভার্সিটি প্রতিষ্ঠিত হয়। যেটি পরবর্তীতে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় নামে নামকরণ হয়। এখানে ১৯৬৩ সালে পশুপালন এবং প্রাণী চিকিৎসা ডিগ্রি পৃথকীকরণ করা হয়। ২০০৬ সালের ৭ আগস্ট দেশের একমাত্র বিশেষায়িত ভেটেরিনারি বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি অ্যান্ড এনিম্যাল সায়েন্স বিশ্ববিদ্যালয় যাত্রা শুরু করে।
শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি অনুষদে রয়েছে ভেটেরিনারি সায়েন্স অনুষদ। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে পটুয়াখালী, হাজী দানেশ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছে ভেটেরিনারি সায়েন্স অনুষদ।
এ ছাড়া ভেটেরিনারি কলেজের ভেতরে ঝিনাইদহ ও সিরাজগঞ্জ সরকারি ভেটেরিনারি কলেজে রয়েছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যায়ের ভেতরে একমাত্র গণ বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছে ভেটেরিনারি সায়েন্স অনুষদ। প্রাণিসম্পদ তথা মানবকল্যাণে দক্ষ ভেটেরিনারিয়ান তৈরির লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠানগুলো নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে।
লেখক: শিক্ষার্থী, গণ বিশ্ববিদ্যালয়, সাভার, ঢাকা।
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: