স্বর্ণ ব্যবসায়ী গোপাল কান্তি দাসকে ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে ২০টি সোনার বার লুট করেছেন ফেনী গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) ৬ কর্মকর্তা। ওই ব্যবসায়ী প্রাণভিক্ষা চাইলে তার কাছে ১ কোটি টাকা চাঁদা দাবি করে তারা। ওই সময় স্বর্ণ ব্যবসায়ী বৈধ কাগজপত্র দেখালে পুলিশ কর্মকর্তারা বলেন, ‘তোর কাছে যতই বৈধ কাগজপত্র থাকুক না কেন, তোকে ক্রসফায়ারে দেব।’ ব্যবসায়ী জানান, ছিনতাই হওয়া ২০টি স্বর্ণের বারের মোট ওজন ২৩৩০ গ্রাম (২ কেজি ৩৩০ গ্রাম)। যার বাজারমূল্য প্রায় ১ কোটি ২৭ লাখ ৮৪ হাজার ৬৩৬ টাকা।
গত রোববার ফেনী মডেল থানার ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ফতেহপুর রেলওয়ে ওভারব্রিজ এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় ভুক্তভোগী ব্যবসায়ী বাদী হয়ে ফেনী মডেল থানায় একটি মামলা করেন। পরবর্তী সময়ে অভিযুক্ত ৬ কর্মকর্তাকে গ্রেফতার করে থানা পুলিশ।
গতকাল বুধবার তাদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত।
যেভাবে ব্যবসায়ীর গাড়ি থামায় ডিবি পুলিশ : ভুক্তভোগী ব্যবসায়ী মামলার এজাহারে উল্লেখ করেন, চট্টগ্রামের কোতোয়ালি থানার হাজারী লেনের ইকুইটি কোহিনূর মার্কেটের দ্বিতীয়তলায় ‘আলো জুয়েলার্স’র স্বত্বাধিকারী তিনি। তার গ্রামের বাড়ি চট্টগ্রামের চকরিয়া উপজেলায়। ওই ব্যবসায়ী এজাহারে বলেন, গত রোববার বিকাল পৌনে ৪টার দিকে একটি প্রাইভেটকারে করে চট্টগ্রাম থেকে ২০ পিস স্বর্ণের বার নিয়ে উন্নতমানের অলঙ্কার তৈরির জন্য ঢাকার তাঁতীবাজারের উদ্দেশে রওনা হন। পথিমধ্যে বিকাল সোয়া ৫টার দিকে ফেনী মডেল থানার ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ফতেহপুর রেলওয়ে ওভারব্রিজের সামনে পৌঁছলে ওয়্যারলেস ও পিস্তলসহ গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের জ্যাকেট পরিহিত চারজন অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তি তার গাড়ি থামতে সিগন্যাল দেয়। এ সময় রাস্তার পাশে আরও কয়েকজন পুলিশ সদস্য দাঁড়ানো ছিল। গাড়ি থামানোর পরপরই জ্যাকেট পরিহিত তিনজন তার গাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়ে। এ সময় তাদের একজন ওই ব্যবসায়ীর মাথায় পিস্তল ধরে ও অন্য আরেকজন গাড়িচালক শওকতকে বেধম মারধর শুরু করে।
যেভাবে স্বর্ণের বার লুট করা হয় : এজাহারে বলা হয়, মারধরের একপর্যায়ে তারা নিজেদের ফেনী ডিবি পুলিশের কর্মকর্তা পরিচয় দিয়ে বলেন, ‘তোদের কাছে অবৈধ মালামাল আছে, তাড়াতাড়ি বের কর।’ তখন অবৈধ মালামাল না থাকার বিষয়টি জানিয়ে আমার কাছে থাকা ২০ পিস বৈধ স্বর্ণের কথা জানাই। তখন তারা ‘ডিবির ওসি স্যার আসতেছে, উনি এলে বিস্তারিত আলাপ হবে’- এমন কথা বলে। এভাবে ২০ থেকে ৩০ মিনিট চলার পর সাদা রঙের একটি কারে করে সাদা পোশাকে একজন কর্মকর্তা আসতেই তারা জোর করে আমাকে ওই গাড়িতে উঠায়। এ ছাড়া যারা সিগন্যাল দিয়ে দাঁড় করিয়েছিল তারা ছিল নীল রঙের আইআরএক্স হায়েসে।
বৈধ কাগজপত্র থাকলেও ক্রসফায়ারে দেব : ব্যবসায়ী বলেন, গাড়িতে ওঠানোর পর ঊর্ধ্বতন ওই কর্মকর্তা স্বর্ণের বারগুলো দেখতে চাইলে তাকে দেখানোমাত্র তিনি কপালে পিস্তল ঠেকিয়ে বলেন, ‘তোর কাছে যতই বৈধ কাগজপত্র থাকুক না কেন এ মুহূর্তে তোকে ক্রসফায়ারে দেব অথবা ৫০০ থেকে ৭০০ পিস ইয়াবা দিয়ে চালান দেব।’ তখন আমি ভয় পেয়ে তাদের কাছে প্রাণভিক্ষা চাইলে তারা বলে, ‘স্বর্ণের বারগুলো তো পাবিই না, তোর এই গাড়ি, ড্রাইভার ও তোর নিজের জীবন বাঁচানোর জন্য ১ কোটি টাকা দিতে হবে।’
শুধু তাই নয়, ঘটনাস্থল থেকে প্রায় আধা কিলোমিটার দূরে ফ্লাইওভারের নিচে রেলগেট সংলগ্ন নির্জন এলাকায় নিয়ে প্রায় ৩ ঘণ্টা শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করে তারা। তাদের নির্যাতনে আমি অসুস্থ হয়ে পড়লে একপর্যায়ে তারা আমাকে দিয়ে এটা বলতে বাধ্য করে যে, ‘আমার কাছে তারা ১২ পিস স্বর্ণের বার পেয়েছে যার বৈধ কাগজ দেখালে তারা আমাকে ছেড়ে দেয়।’ একই সঙ্গে আমার দেওয়া বক্তব্য জোর করে ভিডিও ধারণ করে এবং ঘটনাটি কারও কাছে প্রকাশ করলে প্রাণে মেরে ফেলার হুমকি দেয়। এরপর তাকে ওই কর্মকর্তার গাড়িতেই চোখ বেঁধে অজানা গন্তব্যে রওনা হয়ে বেশ কিছুদূর গিয়ে গাড়িটি এক জায়গায় থামায়।
চোখ খুলে দিলে দেখি বারৈয়ারহাট : ব্যবসায়ী গোপাল কান্তি দাস বলেন, গাড়িটি থামার পর তারা চোখ খুলে দিলে গাড়ি থেকে নেমে জায়গাটি বারৈয়ারহাট বলে দেখতে পাই। ওই সময় তারা আবারও আগের মতো জোর করে স্বীকারোক্তিমূলক ভিডিও ধারণ করে। সবশেষে রাত প্রায় সোয়া ৮টার দিকে আমার গাড়িতে চালক শওকতকেসহ তুলে দিয়ে সোজা বাড়ি ফিরে যেতে বলে। ওই সময় তারা বলে, ‘এখানে যা হয়েছে সব ভুলে যাও’। এ ঘটনা নিয়ে বাড়াবাড়ি করলে মেরে ফেলার হুমকিও দেয় তারা। পরবর্তী সময়ে তিনি গাড়ি নিয়ে সোজা চট্টগ্রামে নিজ বাসায় ফিরে যান।
চট্টগ্রাম ফিরে স্বজন ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে পরামর্শ : ভুক্তভোগী ব্যবসায়ী জিডিতে উল্লেখ করেন, ভয়ভীতি দেখানোর পর রাতেই তিনি বাড়িতে ফিরে ঘটনাটি তার পরিবার, আত্মীয়-স্বজন ও স্বর্ণ ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি-সাধারণ সম্পাদককে জানান। পরে সবার পরামর্শে মঙ্গলবার ফেনী মডেল থানায় হাজির হয়ে বিষয়টি থানার ওসিকে মৌখিকভাবে জানান। তখন ওসি বিষয়টি নিয়ে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করেন। এক পর্যায়ে ওইদিন দুপুর ১টা ২০ মিনিটে পুলিশ লাইনে কর্মরত ডিবির কর্মকর্তাদের জ্যাকেট পরিহিত অবস্থায় হাজির করলে ডিবির ওসি মো. সাইফুল ইসলাম, এসআই মোতাহের হোসেন, এসআই নুরুল হক ও এএসআই মাসুদ রানাকে শনাক্ত করতে সক্ষম হন তিনি। তাদের রোববারের ঘটনা নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করলে তারা স্বর্ণের বার ছিনিয়ে নেওয়ার কথা স্বীকার করে এবং বারগুলো ওসি ডিবির বাসায় রয়েছে বলে জানায়।
যেভাবে বার ছিনতাইয়ের স্বীকারোক্তি : জিজ্ঞাসাবাদে ওসি ডিবি সাইফুল ইসলাম পুলিশকে জানায়, তার নির্দেশে এসআই মোতাহের, এসআই নুরুল হকের দুটি টিম ঘটনাস্থলে গেলেও স্বর্ণের বার ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনা তারা চারজনসহ এসআই মিজানুর রহমান ও এএসআই অভিজিৎ বড়ুয়া জানত এবং অন্যরা জানত না। পরবর্তী সময়ে থানার ওসির নেতৃত্বে একটি টিম ওসি ডিবির বাসায় গেলে তার বেডরুমে থাকা একটি কাঠের আলমারি থেকে কালো ব্যাগে স্কচটেপ দিয়ে মোড়ানো অবস্থায় ১৫টি বার উদ্ধার করে। ১৫টি বারের মধ্যে পাঁচটির প্রত্যেকটি ১১৬.৫৬ গ্রাম করে মোট ৫৮২.৮০ গ্রাম এবং বাকি ১০টির প্রত্যেকটি ১৬৫.৯৭ গ্রাম করে মোট ১৬৫৯.৭০ গ্রাম। অর্থাৎ ১৫টি বারের মোট ওজন ২২৪২.৫০ গ্রাম (২ কেজি ২৪২ গ্রাম) এবং এর বাজারমূল্য ১ কোটি ২৩ লাখ ৪ হাজার ৫৯৭ টাকা। ওই সময় ঘটনাস্থলে উপস্থিত সাক্ষীদের সামনে পুলিশ জব্দকৃত স্বর্ণের বারগুলো তাদের হেফাজতে নেয়। বাকি পাঁচটি বার পাওয়া যায়নি।
সেদিনের ঘটনায় ব্যবসায়ী মানসিকভাবে বিপর্যস্ত : অন্যদিকে গতকাল ওই ব্যবসায়ীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি সময়ের আলোকে জানান, রোববারের ঘটনায় তিনি অসুস্থ ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত অবস্থায় রয়েছেন। বর্তমানে চট্টগ্রামে অবস্থান করছেন। পুলিশ তাকে সহযোগিতা করছে। বর্তমানে তিনি কোনো শঙ্কার মধ্যে নেই বলে জানান। ওই ব্যবসায়ী বলেন, সেদিনের ঘটনায় আমি মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছি। তবে তিনি ন্যায়বিচার পাবেন বলে আশাবাদী।
ডিবি ওসিসহ ছয় পুলিশ রিমান্ডে : ফেনী প্রতিনিধি জানান, ২০টি স্বর্ণের বার ডাকাতি ও লুট করার অভিযোগের মামলায় ফেনী গোয়েন্দা পুলিশের ওসিসহ ছয় পুলিশের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। বুধবার বিকাল সাড়ে ৩টার দিকে দীর্ঘ শুনানি শেষে গ্রেফতারকৃত ডিবি ওসি সাইফুল ইসলামকে ৪ দিন ও এসআই মোতাহের হোসেন, এসআই মিজানুর রহমান, এসআই নুরুল হক এবং এএসআই অভিজিৎ রায় ও এএসআই মাসুদ রানাকে ৩ দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করে ফেনীর সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আবদুল্লাহ খান এ আদেশ দেন। পরে তাদের রিমান্ডে নেওয়ার জন্য কঠোর নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে আদালত থেকে থানায় নিয়ে যায় পুলিশ।
প্রসঙ্গত, ব্যবসায়ী গোপাল কান্তি দাস মঙ্গলবার ফেনী মডেল থানায় বাদী হয়ে ফেনী গোয়েন্দা পুলিশের ওসি সাইফুল ইসলাম ভুইয়াসহ ছয় পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগের ভিত্তিতে রাতেই তাদের গ্রেফতার করা হয়। এ ঘটনায় থানায় ডাকাতি ও মালামাল লুটের অভিযোগে মামলা রেকর্ড করে পুলিশ।
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: