মহান বিজয় দিবসে রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধীনতা স্মারকে শ্রদ্ধা নিবেদনের নামে জাতীয় পতাকা বিকৃত করে প্রদর্শন এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার করে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত পতাকা অবমাননা করার মামলায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৯ শিক্ষক-কর্মকর্তা বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করেছেন আদালত।
সেই সাথে আসামী পক্ষের সকল আসামীকেও মামলা থেকে অব্যাহতি দেবার আবেদন নাকচ করে আদালত।
মঙ্গলবার রংপুর মেট্রোপলিটন তাজহাট আমলি আদালতের বিচারক মো: আল মেহবুব ১৯ আসামীর বিরুদ্ধে চার্জ গঠনের নির্দেশ দেন।
বাদী পক্ষের আইনজীবী রফিক হাসনাইন আসামীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের বিষয়টি নিশ্চিত করে জানান আসামী পক্ষের মামলা থেকে অব্যাহতি দেবার আবেদন খারিজ করে দিয়েছেন।
তবে আদালত এখন পর্যন্ত স্বাক্ষ্যগ্রহণের দিন নির্ধারণ করেনি।
এর আগে মঙ্গলবার দুপুরে আদালতে জাতীয় পতাকা মামলার ১৮ জন শিক্ষক ও একজন কর্মকর্তাসহ ১৯ জন আসামী আদালতে হাজির হন। আসামীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের শুনানী কালে বাদী পক্ষের আইনজীবী খন্দকার রফিক হাসনাইন আদালতে বলেন, ৩০ লাখ মানুষকে হত্যা ও ২ লাখ মা বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা এবং সেই স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকাকে আসামীরা শুধু বিকৃতই করেনি বরং জাতীয় পতাকাকে পদদলিত করে মহান স্বাধীনতার প্রতি চরম অশ্রদ্ধা প্রদর্শন করেছে। আসামীরা এ মামলা থেকে অব্যাহতি পেলে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে জাতীয় পতাকার বদলে চাঁদ তারা পতাকা তোলা হবে।
আইনজীবী আদালতে বলেন, আসামীরা জাতীয় পতাকা বিকৃত করে মহান বিজয় দিবসের দিন স্বাধীনতা স্মারকে প্রদর্শন করেছে শুধু তাই নয় বিকৃত জাতীয় পতাকাকে ফেসবুকে প্রচার করে চরম ধৃষ্টতা দেখিয়েছেন। তাই আসামীদের কোন ভাবেই অনুকম্পা দেখানোর কোন সুযোগ নেই। তিনি পতাকা অবমাননা আইন অনুযায়ী আসামীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করার আবেদন জানান।
এ সময় আসামী পক্ষের আইনজীবী জহুরুল ইসলাম আসামীদের মামলা থেকে অব্যাহতি দেবার আবেদন জানিয়ে বলেন আসামীরা ইচ্ছেকৃত ভাবে জাতীয় পতাকার অবমাননা করেনি।
পরে দুই পক্ষের শুনানী শেষে বিজ্ঞ বিচারক আসামী পক্ষের আবেদন খারিজ করে সকল আসামীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করার আদেশ দেন।
এর আগে এ মামলায় গত ৬ জানুয়ারি সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট তাজহাট আমলি আদালতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক তাবিউর রহমান প্রধানসহ ১৮ জন শিক্ষকসহ এক কর্মকর্তাকে অভিযুক্ত করে ১৯ জনের নামে প্রতিবেদন দাখিল করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ইজার আলী।
পুলিশের দেয়া তদন্ত রিপোর্টে নাম থাকা ১৯ শিক্ষক-কর্মকর্তা হলেন- বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক তাবিউর রহমান প্রধান, গণিত বিভাগের অধ্যাপক ড. আর এম হাফিজুর রহমান, বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. পরিমল চন্দ্র বর্মণ, অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মোরশেদ হোসেন, পরিসংখ্যান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. রশিদুল ইসলাম ও শাহ জামান, ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. নুর আলম সিদ্দিক, পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. কামরুজ্জামান, মার্কেটিং বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মাসুদ উল হাসান, ম্যানেজমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সদরুল ইসলাম সরকার, কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক প্রদীপ কুমার সরকার।
এছাড়াও পরিসংখ্যান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক চার্লস ডারউইন, সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক রামপ্রসাদ বর্মণ, ভূগোল ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক শামীম হোসেন, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের প্রভাষক মো. রহমতউল্লাহ, রসায়ন বিভাগের প্রভাষক মোস্তফা কাইয়ুম শারাফাত, ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের প্রভাষক সোহাগ আলী, পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক আবু সায়েদ এবং পরিসংখ্যান বিভাগের সেকশন অফিসার শুভঙ্কর চন্দ্র সরকারের নাম রয়েছে প্রতিবেদনে।
উল্লেখ্য, ২০২০ সালের ১৬ ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবসে জাতীয় পতাকার নকশা বিকৃতি করে নিজেদের মতো করে তৈরি করা পতাকা নিয়ে ক্যাম্পাসে অবস্থিত স্বাধীনতা স্মারকে ছবি তোলেন এবং পরবর্তীতে ফেসবুকে আপলোড করেন সাবেক ভিসি ড. কলিমউল্লাহ প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করা প্রভাবশালী একাধিক শিক্ষক ও কর্মকর্তা।
পরদিন পতাকা অবমাননার ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক ড. নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ এবং গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক তাবিউর রহমান প্রধানকে প্রধান আসামি করে একাধিক শিক্ষক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে তাজহাট থানায় দু’টি মামলা দায়ের করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মাহামুদুল হক ও মশিউর রহমান এবং সাবেক ছাত্রলীগ নেতা আরিফুল ইসলাম আরিফের। দায়ের করা পৃথক দু’টি অভিযোগের তদন্ত করে সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট তাজহাট আমলি আদালত ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দিয়েছিলেন।
এদিকে জাতীয় পতাকা অবমাননার ঘটনায় রংপুর জেলা প্রশাসন পৃথক তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি করে পতাকা অবমাননার সত্যতা পেয়ে ১৯ শিক্ষক-কর্মকর্তার বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে সাবেক উপাচার্য ড. কলিমউল্লার কাছে প্রতিবেদন দাখিল করে। তবে এখন পর্যন্ত আসামীদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়নি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
এঘটনায় সেসময় দোষীদের শাস্তির দাবিতে মানববন্ধন, বিক্ষোভ সমাবেশসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সংগঠনসহ রংপুর জেলা ও মহানগরের আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ ও বিভিন্ন সামাজিক- সাংস্কৃতিক সংগঠন।
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: