প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার কিলোমিটার দূরের ফিলিস্তিনের প্রতি অব্যাহত সমর্থন জানিয়ে আসছে বাংলাদেশ। ফিলিস্তিনের প্রতি সমর্থন জানানোর অংশ হিসেবে বাংলাদেশ গত ৫০ বছরে ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেয়নি। ইসরায়েলের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ কিংবা সম্পর্কও নেই বাংলাদেশের। এ ছাড়া বাংলাদেশের সাধারণ পাসপোর্টে স্পষ্ট উল্লেখ আছে, ইসরায়েল ছাড়া সব দেশের জন্য এই পাসপোর্ট বৈধ। এ বিষয়টিকেও অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য ইঙ্গিত হিসেবে দেখছেন কূটনীতিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা।
বাংলাদেশে ফিলিস্তিনের রাষ্ট্রদূত ইউসেফ এস ওয়াই রামাদান বলেছেন, ফিলিস্তিনের প্রতি বাংলাদেশের জনগণ ও সরকারের যে আন্তরিকতা, সহযোগিতা ও সহমর্মিতা, তা বিশ্বে বিরল। তিনি নিজে খুব কম দেশেই এমন ভালোবাসা দেখেছেন। ফিলিস্তিনের জনগণ বাংলাদেশের কাছে অত্যন্ত কৃতজ্ঞ।পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন বলেন, ফিলিস্তিনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক ঐতিহাসিক। স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র ও এর জনগণের অধিকারের পক্ষে বাংলাদেশ সরব আছে। আগামীতেও থাকবে।
সংশ্লিষ্ট সরকারি সূত্রগুলো বলছে, ফিলিস্তিন-ইসরায়েল ইস্যুতে বাংলাদেশের প্রকাশ্য ও আড়ালে অবস্থান—দুটিই শতভাগ ফিলিস্তিনের পক্ষে। বাংলাদেশ ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেয়নি। ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেওয়ার চিন্তাও বাংলাদেশ সরকারের নেই।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. লাইলুফার ইয়াসমিন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘১৯৭১ সালে বাংলাদেশের জনগণ যখন মুক্তিযুদ্ধ করছে, তখন ফিলিস্তিনের জনগণ বাংলাদেশকে ব্যাপকভাবে সমর্থন দিয়েছে। তখন তারা তাদের সংবাদপত্রগুলোতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতাসংগ্রামের খবর ব্যাপকভাবে প্রকাশ করেছে। খুব কম দেশই কিন্তু তখন আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছিল। এরপর ফিলিস্তিনি নেতা ইয়াসির আরাফাত ও বঙ্গবন্ধুর মধ্যে জোরালো সম্পর্ক। এগুলো বাংলাদেশ-ফিলিস্তিন সম্পর্কের ভিত্তি।’তিনি আরো বলেন, ‘আমরা ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেব না। কারণ আমরা জানি যে তারা দখলদার। তারা কিভাবে ফিলিস্তিনের ভূখণ্ড কেড়ে নিচ্ছে।’
ড. লাইলুফার ইয়াসমিন মনে করেন, ‘ফিলিস্তিনের সঙ্গে আমাদের ভাতৃত্বের সম্পর্ক কেবল ধর্মের ভিত্তিতে নয়; আমরা যখন তাদের মতো দুর্ভোগের শিকার হচ্ছিলাম তখন ফিলিস্তিনের জনগণ আমাদের সমর্থন-সহযোগিতা দিয়েছে। আমাদেরও দায়িত্ব তাদের পাশে দাঁড়ানো।’
ড. লাইলুফার ইয়াসমিন বলেন, ‘ইসরায়েল কিছুদিন পর পর ফিলিস্তিনে হামলা চালিয়ে বিশ্বকে মনে করিয়ে দেয় যে ফিলিস্তিন আছে। তবে ফিলিস্তিনের প্রতি আমাদের সমর্থন যেন অব্যাহত থাকে, পররাষ্ট্রনীতিতে যেন ফিলিস্তিন ইস্যু কোনোভাবেই উপেক্ষিত না হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে। ফিলিস্তিনের প্রতি আমাদের জনগণের জোরালো সমর্থন আছে।’
জানা গেছে, ফিলিস্তিন, বিশেষ করে প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশনের (পিএলও) সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক ১৯৭১ সাল থেকে। আরব দেশগুলোর বেশির ভাগই যখন দ্বিধাগ্রস্ত ছিল, তখন ফিলিস্তিন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছে। ১৯৭৩ সালের অক্টোবর মাসে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধে বাংলাদেশ ফিলিস্তিনিদের সমর্থন করে। তখন বাংলাদেশ চিকিৎসা, ত্রাণসহ বিভিন্ন সহযোগিতা পাঠিয়েছে। উল্লেখযোগ্যসংখ্যক বাংলাদেশি ফিলিস্তিন, পবিত্র আল-আকসার জন্য সশরীরে লড়াই করেছে। যুক্তরাষ্ট্র কংগ্রেসের লাইব্রেরির ১৯৮৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসের প্রতিবেদনে উল্লেখ আছে, ১৯৮৭ সালে প্রায় আট হাজার বাংলাদেশি যুবক পিএলওতে যোগ দিয়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে লড়াই করেছে। বাংলাদেশ সব সময় ইসরায়েলের দখলদারির নিন্দা এবং ফিলিস্তিনের পক্ষে জোরালো সমর্থন জানিয়ে আসছে। ১৯৭৪ সালে ওআইসি শীর্ষ সম্মেলনের ফাঁকে বঙ্গবন্ধু ও ইয়াসির আরাফাত প্রথম দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করেছিলেন। এরপর ইয়াসির আরাফাত বেশ কয়েকবার বাংলাদেশ সফর করেন। ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস ২০১৭ সালে বাংলাদেশ সফর করেন।
১৯৮৮ সালের ১৫ নভেম্বর ফিলিস্তিন রাষ্ট্র ঘোষণার পর থেকে জাতিসংঘের যে ১৩৮টি দেশ ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিয়েছে বাংলাদেশ তার অন্যতম। ১৯৮০ সালে একজন ফিলিস্তিনি যোদ্ধার ছবিসংবলিত ডাকটিকিটও প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ।
কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, ফিলিস্তিনের ওপর ইসরায়েলি আগ্রাসনের তীব্র নিন্দা জানিয়ে আসছে বাংলাদেশ। ইসলামী সহযোগিতা সংস্থা (ওআইসি), জাতিসংঘেও ফিলিস্তিন ইস্যুতে বাংলাদেশ সরব। বাংলাদেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক আছে এমন অনেক দেশের সঙ্গে ফিলিস্তিনের পাশাপাশি ইসরায়েলেরও নিবিড় সম্পর্ক ও সহযোগিতা আছে। কিন্তু বাংলাদেশ সব সময় ইসরায়েলকে অন্য চোখে দেখেছে।
বর্তমানে ফিলিস্তিনে ইসরায়েলি হামলার বিষয়টি সুরাহা করতে বাংলাদেশ জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইসরায়েলের হামলার নিন্দা জানিয়ে ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসকে চিঠি পাঠিয়েছেন। ফিলিস্তিনের জনগণের জন্য ঢাকায় ফিলিস্তিন দূতাবাসে জরুরি ওষুধ ও অর্থ সহায়তা দিচ্ছে বাংলাদেশের জনগণ।
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: