"নাটকটির নাম 'শুকতারা'। সবার পছন্দের একটি নাটক। তখন রাত ৮ টা বাজে। নাটকটি দেখার জন্য শিক্ষার্থী, কর্মচারী ও ক্যন্টিনবয় সহ সকলে জড়ো হলো টিভি রুমে। ১৯৮৫ সালের ১৫ অক্টোবর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলে টিভি রুমে এক মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটে। যেই ভবনটির ছাদ ধসে দুর্ঘটনাটি ঘটে, ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত সেটিকে বলা হতো 'পরিষদ ভবন' বা 'অ্যাসেম্বলি হল।' শুকতারা' নাটকের এক পর্যায়ে রয়েছে 'মারে ভাত দে' মা জবাব দেয়, বাছা ভাত হলু তাইলে কী হবে ছালুন তো হয়নি এখনো'। টিভির দিকে চেয়ে একথাগুলো শুনতে মনে হলো উপর থেকে কিছু একটা পড়ে গেছে তখনো টিভি চলছে। আমি খোলা আকাশ দেখছি। স্তব্ধ হয়ে গেলাম। কী হলো! এদিক ঐদিক ছোড়াছুড়ি করতে লাগলাম। বর্তমান নিরামিষ মেসের উপর শিক্ষকরা থাকতেন তাদেরকে ডেকে আনলাম। সেন্স ছিলো না তখন বলছিলাম তুরা নিচে নেমে আয়। আমার সামনে সারি সারি লাশ। অনেককে বাঁচানোর চেষ্টা করেও বাঁচাতে পারলাম না। হলের অন্যান্য ভবন থেকে ছাত্ররা আসলো। তারাও বাচাঁনোর চেষ্টা করলো কিন্তু ভাগ্যর নির্মম পরিহাস সেদিন ২৫ জন ছাত্র ও কর্মচারী এবং অতিথি মারা গেলো ১৫ জন। কয়েকশো লোক হয়েছে আহত।"
চাপা কান্নার স্বরে কথাগুলো বলছিলেন ১৯৮৫ সালের ১৫ অক্টোবর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলে ঘটে যাওয়া এক মর্মান্তিক দুর্ঘটনার সাক্ষী, জগন্নাথ হল কর্মচারী কল্যাণ সমিতির সাবেক সভাপতি স্বপন কুমার দে। সেই সময়ের কিশোর স্বপন বর্তামানে ৫২ বছর বয়সী।
তার বাবা জগন্নাথ হলের বাগানের মালী হিসেবে কর্মরত ছিলেন, সেই সূত্রে হল এলাকার ভেতরেই বাস করতো তার পরিবার।
একশো বছরেরও বেশি পুরনো অডিটোরিয়ামটি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান প্রদেশের পরিষদ ভবন বা সংসদ ভবন ছিল, তাই এটি অ্যাসেম্বলি হল বা পরিষদ ভবন হিসেবে পরিচিত ছিল। পরে নতুন পরিষদ ভবন তৈরি হলে ওই ভবনটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে হস্তান্তর করা হয়। এরপর ১৯৮৫ সালের ১৫ই অক্টোবরের মর্মান্তিক ঘটনার আগে পর্যন্ত এটি জগন্নাথ হলের টেলিভিশন কক্ষ হিসেবে ব্যবহৃত হতো।
ওই সময়ের সংবাদপত্র থেকে জানা যায় যে ঘটনায় তাৎক্ষণিকভাবে ৩৪ জন মারা যায়। পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আরও ৬ জনের মৃত্যু ঘটে। নিহতদের স্মরণে জগন্নাথ হলে রয়েছে 'অক্টোবর স্মৃতি ভবন'।
অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিতে গিয়ে বারবার বাষ্পরুদ্ধ হয়ে আসে স্বপন কুমার দে'র কণ্ঠ।
"একটু ধাতস্থ হওয়ার পর আশেপাশে থেকে শুধু 'বাবারে, মা'গো, বাঁচাও' এসব আর্তনাদ শুনছিলাম। তখনও মাথায় ছিল না দুর্ঘটনায় মানুষ মারা গিয়েছিল কি-না। অনেকটা পাগলের মত ছুটে বের হয়ে যাই ওখান থেকে।
"বাইরে গিয়ে সবাইকে একটা কথাই বলতে থাকি, 'ছাদ ধসে পড়েছে।'"
আশেপাশের মানুষকে খবর জানিয়ে ঘটনাস্থলে ফিরে যাওয়ার পরও অনেকক্ষণ অপ্রকৃতস্থ ছিলেন বলে জানান স্বপন কুমার দে।
"তখন আমার বয়স কম ছিল। রক্ত, মৃত্যু, আর্তনাদের মধ্যে কিছুতেই মাথা ঠিক রাখতে পারছিলাম না।"
স্বপন আরো বলেন, "বাংলাদেশে এরকম আর কোন ঘটনা আছে কিনা জানি না যেদিন হিন্দু-মুসলিম এক হয়ে সকাল ভেদাভেদ ভুলে লাশ বহন করছিলো। আর কোনদিন কোথাও এধরণের দুর্ঘটনা যেনো না ঘটে তাঁর জন্য আমাদের সবসময় সতর্ক থাকা জরুরি।"
জগন্নাথ হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. মিহির লাল সাহা বলেন, ''আমি সেসময় ছাত্র ছিলাম। বর্তমানে প্রাধ্যক্ষে হিসেব আছি। সেসময় আমার পরীক্ষা থাকার কারণে আমি টিভি রুমে ছিলাম না হয়তো আমিও নিহতদের অন্তর্ভুক্ত হতাম। আজ ৪০ জন না হয়ে ৪১জন হতে পারতো। ভগবান আমাকে রক্ষা করেছেন।''
এধরণের দুর্ঘটনা যেনো না ঘটে তাঁর জন্য সকলকে সতর্ক থাকার আহবান জানান মিহির লাল।
শুক্রবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শোক দিবস পালিত হবে। দিবসটি পালন উপলক্ষ্যে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করে ও সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে সীমিত পরিসরে এবার দিবসটি পালিত হবে। ১৯৮৫ সালের ১৫ অক্টোবর রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলে সংঘটিত মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় যে সকল ছাত্র, কর্মচারী ও অতিথি নিহত হয়েছেন, তাঁদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য প্রতি বছর এই দিবসটি পালন করা হয়।
শোক দিবস উপলক্ষে কর্মসূচি গ্রহণ করেছে বিশ্ববিদ্যালয়। কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে- সকাল ৬টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান প্রধান ভবন, সকল হল এবং হোস্টেলে কালো পতাকা উত্তোলন, বিশ্ববিদ্যালয়ের পতাকা অর্ধনমিত রাখা ও কালো ব্যাজ ধারণ; উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামানের নেতৃত্বে সকাল সাড়ে ৭টায় জগন্নাথ হল স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ ও নীরবতা পালন; সকাল ৭:৪৫টায় জগন্নাথ হল প্রশাসনের ব্যবস্থাপনায় সংক্ষিপ্ত আলোচনা সভা: নিহতদের আত্মার শান্তি কামনা করে ৯টা থেকে ১০টা পর্যন্ত জগন্নাথ হল প্রাঙ্গণে হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের প্রার্থনা সভা এবং বাদ আছর বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদ মসজিদুল জামিআ'সহ সকল হল মসজিদে দোয়া করা হবে।
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: