১৯৭১ সালের জুলাই মাস। চারদিকে চলছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বর্বরতা। চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার মহারাজপুর ইউনিয়নের ভগবানপুর মন্ডলপাড়া গ্রামের ২৩ বছর বয়সী যুবক তাজেমুল হক প্রতিবেশী এক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের উৎসাহে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েন। অংশ নেন গৌড় বাগানে (প্রশিক্ষণ ক্যাম্প) মৌলিক শারীরিক প্রশিক্ষণে। এরপর কাজ শুরু করেন গোয়েন্দা হিসেবে।
মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারের খোঁজখবর নেওয়া, চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর অবস্থান ও পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে তা মুক্তিযোদ্ধাদের জানানোই ছিল তাজেমুলের কাজ। বর্তমানে এই গোয়েন্দার দিন কাটছে অর্ধাহারে-অনাহারে। স্বাধীনতার ৫০ বছর পরেও মেলেনি স্বীকৃতি। অর্থাভাবে বিনা চিকিৎসায় মানুষের দ্বারে চেয়ে দিন পার করছেন তাজেমুল হক (৭৩)। বাড়ির পাশে থাকা সজনে পাতা বিক্রি ও মানুষের কাছ থেকে দান হিসেবে যা পান তা দিয়েই তাজেমুল ও তার স্ত্রীর দিন কাটে। বসবাস করছেন মাটির পরিত্যক্ত ভাঙা একটি কুঁড়েঘরে।
মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও তাজেমুলের পরিবারের দাবি, মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশ নিলেও মেলেনি তার স্বীকৃতি। স্বীকৃতি তো দূরের কথা এমন অসহায় অবস্থায় দিন পার করলেও তার পাশে দাঁড়ানোর কেউ নেই। তিন মেয়ের বিয়ে দিয়ে এখন স্বামী-স্ত্রী কোনো রকমে অর্ধাহারে-অনাহারে দিন পার করছেন। স্বাধীনতাযুদ্ধে বিজয় লাভের পর অসুস্থ হয়ে পড়ায় নিতে পারেননি সনদ। পরে কিছু কাগজপত্র জোগাড় করতে সক্ষম হলেও তা হারিয়ে ফেলার কারণে এমন দুর্দশা হয়েছে তার। এমনটাই দাবি তার সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া বীর মুক্তিযোদ্ধাদের।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তাজেমুল হকের শারীরিক প্রশিক্ষণে অংশ নেওয়া, গোপনে গোয়েন্দা তথ্য সরবরাহ ও মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় ভূমিকা রাখার তথ্য নিশ্চিত করেছেন মুক্তিযুদ্ধের সাব-সেক্টর কামান্ডার, একাধিক মুক্তিযোদ্ধা সংসদ জেলা ও উপজেলা ইউনিট কমান্ডার এবং জেলার বিভিন্ন উপজেলার বীর মুক্তিযোদ্ধাগণ। এমনকি মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরের সঙ্গে একাধিকবার দেখা হয়েছে বলে জানান তাজেমুল হক।
মুক্তিযুদ্ধের সময় সীমান্তবর্তী জেলা চাঁপাইনবাবগঞ্জ ছিল ৭ নম্বর সেক্টরের অধীনে। এই ৭ নম্বর সেক্টরের ৩ নম্বর সাব-সেক্টর কমান্ডার ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলী কামাল। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে ‘১৯৭১ আমার মুক্তিযুদ্ধ’ শিরোনামে তিনি একটি বই লিখেছেন। তিনি তার বইয়ের ৯৪ পৃষ্ঠায় স্বাধীনতা যুদ্ধে তাজেমুল হকের অবদান ও অংশগ্রহণের বিষয়টি উল্লেখ করেন।
তিনি তার বইয়ে লেখেন, ‘তাজেমুল হক নামে এক ছেলে ছিল, তাট বাড়ি মহারাজপুর চকআলমপুর। তাজেমুল আমাদেরকে গোপনে সংবাদ সরবরাহ করতো। এমনকি আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের বাড়িতে যেত, খোঁজ-খবর নিত।
তাজেমুল মুক্তিযোদ্ধাদের অনেক ব্যক্তিগত ও পারিবারিক কাজ করে দিয়েছেন বলে বইয়ে উল্লেখ করা হয়েছে। মোহাম্মদ আলী কামাল বর্তমানে রাজশাহী মহানগর আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি।
বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. সাইদুর রহমান বলেন, তাজেমুল হক ও আমি একসঙ্গে গৌড় বাগানে মৌলিক প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করি। পরে আমি সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে চলে গেলেও সে প্রশিক্ষণ ক্যাম্পেই থেকে যায়। রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের কয়েক মাস পরেই দেশ স্বাধীন হয়। স্বাধীনতা অর্জনের পরপরই আমরা প্রথমে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও পরে চাঁপাইনবাবগঞ্জ নিউ মার্কেটে অস্থায়ী ক্যাম্পে অস্ত্র জমা দেই ও সনদ গ্রহণ করি। তাজেমুলের সঙ্গে থাকা অনেক মুক্তিযোদ্ধা সেখানে উপস্থিত থাকলেও তিনি ছিলেন না।
তিনি আরও বলেন, মুক্তিযোদ্ধারা প্রকৃত পরিচয় ও আত্মমর্যাদা পেয়েছেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা শেখ হাসিনা ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আসার পর। ওই সময় থেকে তাজেমুলের জন্য একাধিকবার বিভিন্ন জায়গায় সুপারিশ করলেও তার মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি মেলেনি। এখন খুবই অসহায় অবস্থায় দিন যাপন করছেন তাজেমুল। শারীরিক নানা অসুস্থতায় ভুগলেও অর্থাভাবে চিকিৎসা করাতে পারছেন না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য যা করেছেন, তা আমাদের কল্পনারও বেশি। তাই তাজেমুলের প্রতি নজর দিতে সরকারের প্রতি অনুরোধ জানাই।
তাজেমুল হকের মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন মুক্তিযোদ্ধা সংসদ চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা ইউনিটের কামান্ডের সাবেক কমান্ডার মো. গোলাম রাব্বানী, সাবেক জেলা কমান্ডার মো. সিরাজুল হক ও সাবেক সদর উপজেলা কমান্ডার মো. আব্দুর রহমান। তারা তাজেমুলকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে যাচাই-বাছাই করতে সুপারিশ করেছেন।
স্থানীয় বাসিন্দা আমির ফয়সাল বলেন, আমার বাবাও একজন মুক্তিযোদ্ধা। তিনি সরকারের দেওয়া সকল সুযোগ-সুবিধা পেয়ে থাকেন। আমার বাবা মাঝেমধ্যেই তাজেমুলের সঙ্গে যুদ্ধে অংশগ্রহণ ও বিভিন্ন জায়গায় অভিযানের কথা বলেন। কিন্তু তাজেমুলের কোনো স্বীকৃতি মেলেনি। একমাত্র ছেলে দীর্ঘদিন আগে বজ্রপাতে মারা গেছে। অনেক কষ্টে তিন মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। এখন খুব অসহায় ভাবে দিন যাচ্ছে তার। মারা যাওয়ার আগে তার নামটি যেন মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় থাকে।
তাজেমুলের প্রতিবেশী জালাল উদ্দীন বলেন, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে আমার বয়স ছিল ১০-১২ বছর। এ সময় তাজেমুলকে আমি দেখেছি একটা ডিম কেনার ঝুড়ি নিয়ে দু-এক দিন পরপর শহরে যেতে। অথচ সে কোনো দিন ডিমের ব্যবসা করেনি। উদ্দেশ্য ছিল শহরে গিয়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর অবস্থান ও সংখ্যাসহ নানা তথ্য সংগ্রহ করে মুক্তিযোদ্ধাদেরকে তা অবহিত করা।
স্থানীয় বাসিন্দা আলমগীর হোসেন ও সাদিকুল ইসলাম বলেন, তাকে দেখার মতো কেউ নাই। অনেক রোগ তার শরীরে বাসা বেঁধেছে। তাকে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি ও আর্থিকভাবে সহায়তা না করলে অকৃতজ্ঞ হিসেবে আমরা সকলেই দায়ী থাকব।
বয়সের ভারে খুব একটা কথা বলতে পারেন না তাজেমুল হক। আধো আধো কণ্ঠে তিনি বলেন, ১৯৭১ সালের জুলাই মাসের শেষ দিকে সাব-সেক্টর কমান্ডার মোহাম্মদ আলী কামাল মিয়া আমাকে সঙ্গে করে যুদ্ধে নিয়ে যান। প্রশিক্ষণ শেষে কানসাটের কলাবাড়িতে একটি সম্মুখযুদ্ধে অংশ নিয়েছি। ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীরের জানাজায় অংশ নিয়েছি। কিন্তু দেশ স্বাধীন হওয়ার পর অসুস্থ থাকার কারণে সনদ নিতে যেতে পারিনি। আর তাই আমার আজকে এই অবস্থা। সবাই মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে কত সম্মান ও আর্থিক সহায়তা পায়, কিন্তু আমার কপালে কিছুই জোটে না।
তাজেমুলের স্ত্রী খৈয়মন বেগম, দুই মেয়ে মটরী খাতুন ও পেয়ারা বেগম জানান, স্বাধীনতা যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে যুদ্ধের অনেক স্মৃতি তাদের সঙ্গে শেয়ার করেছেন তাদের বাবা। এখন মানসিকভাবেও অসুস্থ হতে শুরু করেছেন। কোনো কিছু মনে থাকে না। ভালোভাবে কথাও বলতে পারেন না। তবে যেসব কাগজপত্র সংগ্রহ করতে পেরেছিলেন, তা সব সময় নিজে বয়ে বেড়ান। কাউকে দেখতেও দেন না, নষ্ট হয়ে যাওয়ার ভয়ে।
মহারাজপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নাহিদ ইসলাম রাজন বলেন, তাজেমুল হককে আমরা ছোট থেকেই একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে জানি। এমনকি তার সাথে যুদ্ধে অংশ নেয়া লোকজনও তার কথা বলেন। কিন্তু এখনও তার স্বীকৃতি মেলেনি। এখন খুবই অসহায় অবস্থায় দিন যাপন করছে তিনি। ইউপি চেয়ারম্যান হিসেবে আমার দাবি, তাকে তার প্রাপ্য সম্মান দেওয়া হোক।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইফফাত জাহান বলেন, আমি যোগদানের আগেই এখানে মুক্তিযোদ্ধাদের যাচাই-বাছাই সম্পন্ন হয়ে গেছে। সে সময় তাজেমুল হক আবেদন করেছিলেন কিনা বা করে থাকলে কেন বাদ পড়লেন তা পর্যালোচনা করে দেখতে হবে। এমনকি উপজেলা পর্যায়ে বাদ পড়লে পরবর্তীতে আপিল করারও সুযোগ ছিল। তা করেছেন কিনা সেটিও জেনে দেখব। এছাড়াও একজন অসহায় মানুষ হিসেবে তার বিষয়ে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের মাধ্যমে খোঁজখবর নিয়ে উপজেলা প্রশাসন তার পাশে দাঁড়াবে।
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: