পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সান্ধ্যকালীন, উইকেন্ড ও এক্সিকিউটিভ কোর্সগুলো বন্ধের সুপারিশ করেছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)।
কমিশনের সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদনে এ কথা বলা হয়েছে।
ইউজিসি বলছে, এই কোর্সগুলোর কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে।
ইউজিসি কর্মকর্তারা বলেছেন, এই কোর্সগুলো নিয়ন্ত্রিত নয় এবং বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে পরিচালিত হচ্ছে।
প্রতিবেদনে ইউজিসি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের টিউশন এবং অন্যান্য ফি এর ক্ষেত্রে সামঞ্জস্যতার সুপারিশ করেছে।
প্রতিবেদনে একটি মিশ্রিত শিক্ষা মডেল প্রস্তুত করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে যা অনলাইন এবং স্ব-শরীরের ক্লাসকে একত্রিত করবে এবং হাইব্রিড মডেলের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে পরীক্ষা পদ্ধতির পরিবর্তন করবে।
ইউজিসি 'বার্ষিক প্রতিবেদন ২০২০'-এ উচ্চ শিক্ষার জন্য বাজেট বরাদ্দ বাড়ানোসহ বেশ কয়েকটি সুপারিশ করেছে।
এতে বলা হয়েছে, ২০২২ সালের মধ্যে জাতীয় বাজেটের অন্তত ২ শতাংশ এবং ২০৩০ সালের মধ্যে ৬ শতাংশ উচ্চ শিক্ষার জন্য বরাদ্দ করতে হবে।
উচ্চ শিক্ষায় বর্তমানে জাতীয় বাজেটের শুন্য দশমিক ৮৭ শতাংশ বরাদ্দ রয়েছে।
ইউজিসি সদস্য অধ্যাপক মুহম্মদ আলমগীর জানান, ইউজিসির চেয়ারম্যান অধ্যাপক কাজী শহীদুল্লাহর নেতৃত্বে ইউজিসির একটি প্রতিনিধি দল গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের কাছে প্রতিবেদনটি জমা দিয়েছে এবং বেশ কয়েকটি সুপারিশ করেছে।
সুপারিশ:
বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে ভর্তি ফি, টিউশন ফি, শিক্ষকদের বেতন-ভাতা ইত্যাদি বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ভেদে ভিন্নতা তথা অসামঞ্জস্যতা রয়েছে। তাছাড়া শিক্ষার্থীদের ট্রান্সক্রিপ্ট, সাটিফিকেট, প্রশংসাপত্র ইত্যাদি সরবরাহ করার ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ উচ্চহারে ফি নিয়ে থাকে। এমনকি কোনো যৌক্তিক কারণ ব্যতিরেকেই প্রতি বছর টিউশন ফি ও ভর্তি ফিসহ অন্যান্য ফি বৃদ্ধি করে থাকে বলে অভিযোগ রয়েছে। যেহেতু দেশের সকল অঞ্চলের আর্থ-সামাজিক অবস্থা সমান নয়, সেহেতু শিক্ষার্থীদের প্রদেয় বিভিন্ন প্রকার ফি ও চার্জ একটি যৌক্তিক পর্যায়ে নির্ধারণ করা প্রয়োজন। এ বিষয়ে সরকার। প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়সমূহকে নির্দেশনা দিতে পারে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, দেশের কোনো কোনো পাবলিক ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে সান্ধ্যকালীন/উইকেন্ড/এক্সিকিউটিভ প্রভৃতি কোর্স পরিচালিত হচ্ছে, যা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামগ্রিক কর্মকাণ্ডে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। এ ধরনের কোর্স পরিচালনা করা বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈশিষ্ট্য ও ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করে বিধায় সান্ধ্যকালীন/উইকেন্ড/এক্সিকিউটিভ জাতীয় সকল কোর্স বন্ধ হওয়া জরুরি। তবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ইউজিসি থেকে অনুমোদন নিয়ে নির্দিষ্ট নীতি অনুসরণ করে ডিপ্লোমা, সংক্ষিপ্ত কোর্স এবং বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণের ওপর কোর্স চালাতে পারে।
ইউজিসি চেয়ারম্যান কাজী শহীদুল্লাহ বলেন, 'অনেক বিশ্ববিদ্যালয় বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে এই সান্ধ্যকালীন, উইকেন্ড এবং এক্সিকিউটিভ কোর্স পরিচালনা করছে এবং সেগুলো নিয়ন্ত্রিত নয়।'
তিনি জানান, এই কোর্সগুলো ইচ্ছে মতো খোলা হচ্ছে এবং কিছু ক্ষেত্রে মাত্র ২ বছর আগে খোলা বিভাগগুলো উইকেন্ড ও সান্ধ্যকালীন কোর্স পরিচালনা করছে।
তিনি বলেন, আমরা এমন কোর্সের অনুমতি দিচ্ছি যেগুলো একাডেমিক উদ্দেশ্যে কাজ করবে এবং ভালোভাবে নিয়ন্ত্রিত হবে।
এক ইউজিসি সদস্য জানান, তারা মুনাফার উদ্দেশ্যে পরিচালিত কোর্সগুলো বন্ধ করার পক্ষে।
তিনি বলেন, 'আমরা সান্ধ্যকালীন, উইকেন্ড এবং এক্সিকিউটিভ কোর্সসহ প্রতিবেদনে বেশ কয়েকটি বিষয়ের উপর জোর দিচ্ছি।'
ইউজিসি সদস্য অধ্যাপক বিশ্বজিৎ চন্দ জানান, প্রতিবেদনে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে টিউশন এবং অন্যান্য ফি যৌক্তিক করার আহ্বান জানানো হয়েছে। কারণ একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে নানা অসঙ্গতি এবং ব্যাপক পার্থক্য রয়েছে।
অনেক ক্ষেত্রেই ২টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে একই বিষয়ের টিউশন ফি-তে অনেক পার্থক্য রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'কিছু পার্থক্য থাকতে পারে, কিন্তু যদি একটি বিশ্ববিদ্যালয় একটি কোর্সের জন্য ৪ লাখ টাকা নেয় এবং অন্যটি একই বিষয়ের জন্য ৮ বা ৯ লাখ টাকা টিউশন ফি নেয়, তবে এটি একটি বিস্তর ব্যবধান।'
ইউজিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, উদ্বেগের বিষয় যে গবেষণায় চুরির অভিযোগ বাড়ছে। গবেষণায় চুরি বন্ধে একটি সুনির্দিষ্ট নির্দেশিকা এবং সফটওয়্যারের ব্যবহার বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে সরকারি তহবিলে একটি কেন্দ্রীয় গবেষণা ল্যাবরেটরি এবং জাতীয় গবেষণা কাউন্সিল প্রতিষ্ঠার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এছাড়াও যোগ্য শিক্ষক তৈরির জন্য বিশ্ববিদ্যালয় টিচার্স ট্রেনিং একাডেমি গঠনের সুপারিশ করা হয়েছে।
নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি অ্যাক্ট, ২০১০ সংশোধন করার আহ্বান জানিয়ে এটিকে যুগোপযোগী করতে বলেছে।
ইউজিসি সদস্যরা জানান, রাষ্ট্রপতি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার মান নিশ্চিত করতে এবং প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করতে সবার প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
তারা বলছেন, 'রাষ্ট্রপতি প্রতিটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য পৃথক আইনের পরিবর্তে সব বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য একই আইন প্রণয়নের আহ্বান জানিয়েছেন।'
এক ইউজিসি সদস্য বলেন 'তিনি ৪টি শীর্ষস্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়) ব্যতীত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য নিয়োগের জন্য একটি নীতিমালা প্রণয়নের পরামর্শ দিয়েছেন।'
ইউজিসি প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশে ১৫৭টি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। সেগুলোর মধ্যে ৫০টি সরকারি এবং ১০৭টি বেসরকারি। এর মধ্যে ৪টি সরকারি ও ৮টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এখনো একাডেমিক কার্যক্রম শুরু করতে পারেনি।
দেশে উচ্চশিক্ষায় ৪৬ লাখ ৯ হাজার শিক্ষার্থী রয়েছে। তাদের মধ্যে ৩ লাখ ২৮ হাজার বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে।
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: