নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে হাসেম ফুডসের কারখানায় আগুনে পুড়ে ৫১ জনের প্রাণহানির ঘটনায় তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে তদন্ত কমিটি। জেলা প্রশাসনের গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে মালিক কর্তৃপক্ষ এবং সরকারি দুই সংস্থা শ্রম অধিদপ্তর এবং কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের গাফিলতির প্রমাণ উঠে এসেছে।
এছাড়া তদন্তে কারখানায় নানা ধরনের অনিয়মের চিত্রও উঠে এসেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শ্রম অধিদপ্তর এবং কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর যথেষ্ট দায়িত্ব নিয়ে কাজ করেনি। তারা ঠিকঠাকমতো দায়িত্ব নিয়ে মনিটরিং (তদারকি) করলে এই দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি এড়ানো যেত।
নারায়ণগঞ্জের জেলা প্রশাসক মোস্তাইন বিল্লাহ্ তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের বিষয়টি গণমাধ্যমকে নিশ্চিত করেছেন।
তিনি বলেন, গত বৃহস্পতিবার রাতে তদন্ত কমিটি আহ্বায়ক অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) শামীম ব্যাপারী জেলা প্রশাসকের কাছে ৪৪ পৃষ্ঠার এই তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন।
জেলা প্রশাসক মোস্তাইন বিল্লাহ্ বলেন, ওই কারখানায় অগ্নিনির্বাপণে পর্যাপ্ত সরঞ্জামাদির ব্যবস্থা ছিল না, আগুন নেভানোর জন্য কারখানায় প্রশিক্ষিত জনবল (শ্রমিক) ছিল না, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের এনওসি (অনাপত্তিপত্র) পাওয়া যায়নি, পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র ছিল না, বিল্ডিং কোড না মেনে ভবন নির্মাণ, শিশুশ্রমসহ নানা অনিয়ম পেয়েছে তদন্ত কমিটি।
আগুন লাগার কারণ সম্পর্কে তদন্ত কমিটি বলেছে, নিচতলায় কেন্দ্রীয় কমপ্রেসারের কক্ষে বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়, দাহ্য পদার্থ থাকায় আগুন দ্রুত কারখানার ভেতরে ছড়িয়ে পড়ে। কারখানায় এই ধরনের প্রাণহানি রোধে তদন্ত কমিটি ২০টি সুপারিশও করেছে।
এর আগে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের তদন্তে উঠে আসে, অতিরিক্ত তাপে কারখানার নিচতলার একটি এগজস্ট ফ্যানের তার গলে আগুনের সূত্রপাত হয়। সেখানে অনেক দাহ্য পদার্থ থাকায় দ্রুত আগুন ছড়িয়ে পড়ে। এ ছাড়া ওই কারখানায় অগ্নিদুর্ঘটনা প্রতিরোধে কোনো ব্যবস্থা ছিল না। এ কারণে প্রাণহানি বেশি হয়েছে।
জেলা প্রশাসক বলেন, কারখানার নিচতলার কেন্দ্রীয় গুদামের কমপ্রেসারের রুমের এক পাশে বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়। রাসায়নিকের উপস্থিতি থাকায় আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। আগুন লাগার পর ধোঁয়া বের হলে শ্রমিকদের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দেয়। তখন চতুর্থ তলার ফ্লোর ইনচার্জ শ্রমিকদের আশ্বস্ত করেন, আগুন নিভে যাবে। এরপর শ্রমিকদের তাঁর রুমে নিয়ে যান। পরে আগুন ছড়িয়ে পড়লে শ্রমিকেরাসহ তিনি ওই রুম থেকে আর বের হতে পারেননি, সেখানেই একটি কক্ষে আগুনে পুড়ে তাঁদের মৃত্যু হয়। তদন্ত কমিটি কারখানার প্রতি তলায় নেট দিয়ে প্রতিবন্ধকতা তৈরির প্রমাণ পেয়েছে।
জেলা প্রশাসক মোস্তাইন বিল্লাহ্ বলেন, তদন্ত কমিটি আগুনে বেঁচে যাওয়া ওই কারখানার শ্রমিক, সংশ্লিষ্ট মোট ২১ জনের জবানবন্দি নিয়েছেন। তদন্ত কমিটি সরকারি নয়টি সংস্থাকে সঙ্গে নিয়ে তদন্ত কাজ করেছে।
তদন্ত কমিটি কারখানায় শিশুশ্রম বন্ধে নিয়মিত তদারকি করা, যেসব শ্রমিক মারা গেছেন তাঁদের শ্রম আইন অনুসারে কারখানার মালিকপক্ষ থেকে দুই লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ প্রদান, বেঁচে যাওয়া শ্রমিকদের আড়াই লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ প্রদান, নিহত শ্রমিকদের পরিবারের কর্মক্ষম কেউ থেকে থাকলে তাঁকে ওই মালিকের অন্য কারখানায় চাকরির ব্যবস্থাসহ ২০ দফা সুপারিশ পেশ করেছেন।
জেলা প্রশাসক মোস্তাইন বিল্লাহ্ বলেন, প্রতিটি বিভাগ যদি ঠিকভাবে কারখানা মনিটরিং (তদারকি) করত, তাহলে সেখানে শিশুশ্রম থাকত না, বিল্ডিং কোর্ডের অসংগতি থাকত না। ফায়ার সেফটি ব্যবস্থা পর্যাপ্ত থাকত। তাহলে এই দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি এড়ানো যেত। তাদের তদারকির কমতি পেয়েছে তদন্ত কমিটি।
জেলা প্রশাসক জানান, তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন শ্রম মন্ত্রণালয়, মন্ত্রিপরিষদসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে। তারা এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে।
গত ৮ জুলাই হাসেম ফুডস কারখানায় আগুনে পুড়ে ৪৮ জনসহ মোট ৫১ (লাফিয়ে পড়ে ৩ জন) জনের মৃত্যু হয়। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা ৪৮ ঘণ্টার চেষ্টা চালিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনের। এই ঘটনা তদন্তে জেলা প্রশাসন, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স এবং কলকারখানা প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর পৃথক তিনটি তদন্ত কমিটি গঠন করেন। নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে আলাদা আরও একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। ডিএনএ পরীক্ষা শেষে নিহত ব্যক্তিদের লাশ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গ থেকে ৪৫ জনের লাশ হস্তান্তর করেছে সিআইডি। তিনজনের লাশ ডিএনএ পরীক্ষা শনাক্ত হওয়ার পর হস্তান্তর করবে সিআইডি।
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: