লেখাপড়া করে মানুষের মত মানুষ হবে। বাবা মায়ের মুখ উজ্জল করবে। সমাজে অবদান রাখবে। দেশসেবায় নিজেকে আত্ননিয়োগ করবে এমন বুক ভরা আশা নিয়ে ছেলে আদিত্য বর্ম্মনকে লেখাপড়ায় মনোনিবেশ করিয়েছেন তার দরিদ্র পিতা অবিনাশ রায়। অনেক কষ্ট করে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার গন্ডি পার করিয়ে ছেলেকে ভর্তি করান কলেজে। আদিত্যেরও স্বপ্ন ছিল লেখাপড়া করে দেশ মাতৃকার সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করতে, একদিন সে সেনাবাহিনীর গর্বিত সদস্য হবে। সে লক্ষ্যেই প্রস্তুতও করে নিজেকে।
চলতি বছরের দুই ডিসেম্বর শুরু হওয়া এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার কথা ছিল আদিত্যের। কিন্ত নিয়তির কি নির্মম পরিহাস আদিত্যের সে আশা অধরাই রয়ে গেল। আদিত্য অংশ নিতে পারল না এইচএসসি পরীক্ষায়।
পরীক্ষা শুরু হওয়ার তিনদিন আগে নির্বাচনী সহিংতায় বিজিবি’র ছুড়ে দেওয়া বুলেটে অকালে মৃত্যুর কোলে ঢোলে পড়েন অত্যন্ত হাসিখুশি ও মেধাবী শিক্ষার্থী আদিত্য বর্ম্মন। নিমিষেই সব আশা আকাঙ্ক্ষা চুড়মাড় হয়ে যায় আদিত্য ও তার বাবা মায়ের এতদিনের স্বপ্নের।
আদিত্যের বাড়ি ঠাকুরগাঁও জেলার পীরগঞ্জ উপজেলার খনগাঁও ইউনিয়নের ঘিডোব গ্রামে। নিম্নবিত্ত পরিবারের বড় সন্তান সে। ঘিডোব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ৫ম শ্রেনী পাস করে ভর্তি হয় উপজেলার উজ্জলকোঠা উচ্চ বিদ্যালয়ে। সেখান থেকে কৃতিত্বের সাথে জেএসসি এবং এসএসসি পাস করার পর পীরগঞ্জ লোহাগাড়া ডিগ্রী কলেজে এইচএসসি মানবিক শাখায় ভর্তি
করানো হয় তাকে। এবারের এইচএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করার পরীক্ষার্থী ছিল সে।
ভাল ফল করতে সকল প্রস্তুতিও নেয় আদিত্য। সবকিছুই ঠিকঠাক ছিল। কিন্তু সেই কালরাত্রি ২৮ নভেম্বর তৃতীয় ধাপে অনুষ্ঠিত ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে ঘিডোব সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভোটের ফলাফলকে কেন্দ্র করে জনতার সাথে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংঘর্ষ বাঁধলে বিজিবি’র গুলিতে প্রাণ হারায় আদিত্য সহ তিনজন। এখানেই সকল স্বপ্নের মৃত্যু হয়, সাথে পন্ড হয়ে যায় সবকিছুই ।
আদিত্যের পিতা অবিনাশ কান্নাজড়িত কন্ঠে বলেন, গোলাগুলির সময় ছেলে আদিত্য বাড়িতে রাতের খাবার ভাত খাচ্ছিলেন। গোলাগুলির শব্দ শুনে বাড়ি থেকে বের হয়ে স্কুলের দিকে যেতেই তার মাথায় গুলি লাগে। গুরুতর অবস্থায় রংপুর মেডিকলে নিয়ে যাওয়ার পথিমধ্যে আদিত্য মারা যায়।
আদিত্যর মা পার্বতী রানীর কাছে জানতে গেলে সেসময় ছেলেকে হারানোর আহাজারিতে আশপাশের এলাকা যেন স্তব্ধ হয়ে যায়। মা পার্বতী রানী কাঁদতে কাঁদতে বলতে থাকেন তার ছেলের স্বপ্ন ছিল লেখাপড়া করে দেশ মাতৃকার সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করতে সেনাবাহিনীর গর্বিত সদস্য হবে। তারাও আশায় বুক বেঁধে ছিলেন ছেলে আদিত্য লেখাপড়া করে দেশের কাজে লাগবে! বাবা-মায়ের মুখ উজ্জ্বল করবে। সেই আশা নিরাশায় পরিণত হল।
আদিত্যের একমাত্র ছোটভাই নবম শ্রেনীর ছাত্র উপাচার্য বম্মন জানান, ভাইয়ের এমন মৃত্যুতে সে মানসিকভাবে শক্তি হারিয়ে ফেলেছি। বলার মত কোন ভাষা খুঁজে পাচ্ছিনা। নির্বাক নিঃশব্দে অপলক দৃষ্টিতে খুঁজে ফিরেন হারিয়ে যাওয়া একমাত্র ভাই আদিত্য কে!
লোহাগাড়া ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ মোজাম্মেল হক বলেন, অত্যন্ত হাসিখুশি ভদ্র নম্র ও মেধাবী ছাত্র ছিলেন আদিত্য বর্ম্মন। চলতি এইচএসসি পরীক্ষায় তার এই কলেজ থেকে শিবগঞ্জ কলেজ পরীক্ষা কেন্দ্রে এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নেবার কথা ছিল। কিন্তু সেটা আর হলোনা। আদিত্যের জন্য আমরা সবাই শোকাহত।
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: