পঞ্চগড়ে আহমদিয়া সম্প্রদায়ের (কাদিয়ানি) ও পুলিশের ওপর সালানা জলসা বন্ধের দাবিতে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ ও হত্যার ঘটনায় এবং গুজব ছড়িয়ে পুনর্বার হামলার ঘটনায় এপর্যন্ত সর্বমোট ১০টি মামলা দায়ের করা হয়েছে।
আজ মঙ্গলবার (৭ মার্চ) সকাল পর্যন্ত ১০টি মামলায় এ পর্যন্ত মোট ১৩০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আন্দোলন ও সংঘর্ষের ঘটনার পর থেকে প্রতিদিনই করা হচ্ছে নতুন নতুন মামলা। সোমবার সন্ধ্যা পর্যন্ত গ্রেপ্তার হওয়া ৮১ জনকে আদালতের মাধ্যমে জেল হাজতে পাঠানো হয়েছে। এরপর রাতভর অভিযান চালিয়ে আরও ৪৯ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। এসব মামলায় ২৭ জনের নামসহ অজ্ঞাত আসামি করা হয়েছে আরও প্রায় সাড়ে ৬ হাজার জনকে। মঙ্গলবার জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে সাংবাদিকদের এসব তথ্য জানানো হয়।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ব্যাপক অভিযান ও নজরদারিতে জেলা শহরের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে। স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে দোকানপাট, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের পরিস্থিতিও। তবে নিরপরাধ কাউকে গ্রেপ্তার করে হয়রানি করা হবে না বলে পুলিশের পক্ষ থেকে আশ্বস্ত করা হয়েছে।
হামলা, সংঘর্ষ ও হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় গত শনিবার (৪ মার্চ) রাতে পঞ্চগড় সদর থানায় আহমদিয়া সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে একটি এবং পুলিশের পক্ষ থেকে দুটি মামলা করা হয়। এরপর রোববার (৫ মার্চ) রাতে পঞ্চগড় সদর থানায় র্যাব বাদী হয়ে একটি এবং পুলিশ বাদী হয়ে আরও দুটি মামলা করে। এরপর সোমবার রাতে জেলার বোদা থানায় আহমদিয়া সম্প্রদায় ও পুলিশ দুটি এবং পঞ্চগড় সদর থানায় আরও দুটি মামলা করেছে পুলিশ। এতে সদর থানার মামলার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে আটটি এবং বোদা থানায় মামলার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে দুটি। এসব মামলায় আসামি প্রায় ১০ হাজার বলে জানা গেছে।
পুলিশ জানায়, পুলিশের ওপর হামলা, গাড়ি ভাঙচুর, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া, আহমদিয়া সম্প্রদায়ের বাড়িঘরে হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, তাদের আটটি দোকানে লুটপাট, গুজব ছড়িয়ে আবারও হামলা, অগ্নিসংযোগের ঘটনায় এ পর্যন্ত দশটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। এসব মামলায় মঙ্গলবার সকাল পর্যন্ত ১৩০ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। শনিবার রাতে আহমদিয়া সম্প্রদায়ের নিহত জাহিদ হাসানকে হত্যার অভিযোগে ওসমান আলী বাদী হয়ে সদর থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। ওই মামলায় অজ্ঞাত ৪০০ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করা হলেও কারও নাম উল্লেখ করা হয়নি। তবে হামলা, ভাঙচুর, সরকারি কাজে বাধাদানসহ একাধিক অভিযোগে পুলিশের করা বিভিন্ন মামলায় ১২ জনের নামসহ তিন হাজার ৫০০ থেকে তিন হাজার ৬০০ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়েছে। মোটরসাইকেল চালিয়ে এবং সামাজিক মাধ্যমে গুজব ছড়ানোর অভিযোগে পুলিশের করা আরেকটি মামলায় ১৫ জনের নামসহ দুই হাজার ৬০০ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়েছে। তবে মামলা ও পুলিশি গ্রেপ্তার আতঙ্কে জেলা শহরসহ বিভিন্ন উপজেলার বিএনপি নেতাকর্মীসহ স্থানীয়রা পালিয়ে বেড়াচ্ছেন বলে অভিযোগ বিএনপির।
গ্রেপ্তারদের মধ্যে আহমদিয়া সম্প্রদায়ের যুবক জাহিদ হাসানকে হত্যার অভিযোগে শহরের রাজনগর এলাকার ইসমাইল হোসেন ঝনু (২৫) এবং তুলারডাঙ্গা মহল্লার রাসেল হোসেনকে (২৮) গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে এরা হত্যায় জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছেন বলে জানিয়েছে পুলিশ। আর মোটরসাইল চালিয়ে এবং ফেসবুকে গুজব ছড়ানোর অভিযোগে পঞ্চগড় পৌর যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক ফজলে রাব্বি (২৯) এবং রাব্বী ইমনকে (২৬) গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। এসব মামলায় সোমবার পর্যন্ত গেপ্তার ৮১ জনকে আদালতের মাধ্যমে জেলহাজতে পাঠানো হয়েছে। গ্রেপ্তারদের মধ্যে ঘটনার সঙ্গে জড়িত বিএনপি-জামায়াত নেতারাও রয়েছেন বলে পুলিশ জানায়।
অন্যদিকে বিএনপি নেতাকর্মীরা জানান, শুক্রবারের সালানা জলসার প্রতিবাদে একদিন আগে বৃহষ্পতিবার বিক্ষোভ করেছিলেন সাধারণ মুসল্লিরা। এ নিয়ে পুলিশ ও প্রশাসনের কোনো পূর্ব প্রস্তুতি ছিল না। তারা আহমদিয়া সম্প্রদায়কে নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। তারা বলেন, ‘আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় আরও কঠোর ব্যবস্থা নিলে হয়তো এমন ঘটনা ঘটত না। এখন ঢালাওভাবে পাঁচ উপজেলার বিএনপি নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে।’
পুলিশ সুপার এসএম সিরাজুল হুদা বলেন, মঙ্গলবার সকাল পর্যন্ত পুলিশের পক্ষ থেকে বিভিন্ন আইন ও ধারায় মোট দশটি মামলা করা হয়েছে। সোমবার রাত থেকে মঙ্গলবার সকাল পর্যন্ত আরও ৩৩ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এ নিয়ে মোট গ্রেপ্তারের সংখ্যা ১৩০ জন। আরও মামলা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। আমরা তদন্তের মাধ্যমে, ভিডিও ফুটেজ দেখে, বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত যাচাই করে অপরাধে জড়িতদে গ্রেপ্তার করছি।
তিনি বলেন, হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার দুইজন প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জাহিদ হাসানকে কুপিয়ে হত্যার কথা স্বীকার করেছেন। বর্তমানে জেলার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে। আমরা ঘটনার সঙ্গে সক্রিয়ভাবে জড়িতদেরই গ্রেপ্তার করছি। এখানে কোনো নিরীহ মানুষকে হয়রানির সুযোগ নেই। তবে হামলাকারীরা যেই হোক না কেন, তাদের ছাড় দেওয়া হবে না।
প্রসঙ্গত, পঞ্চগড় শহরের উপকণ্ঠে আহম্মদনগর এলাকায় আহমদিয়া জামাতের জলসা বন্ধের দাবিতে গত শুক্রবার দুপুরে জুমার নামাজের পর পঞ্চগড় শহরের বিভিন্ন মসজিদ থেকে মিছিল বের করা হয়। মিছিল নিয়ে বিক্ষোভকারীরা শহরের চৌরঙ্গী মোড়ে সমাবেত হন। সেখান থেকে তারা মিছিল নিয়ে করতোয়া সেতুর দিকে যেতে চাইলে পুলিশ তাদের থামিয়ে দেয়। একপর্যায়ে বিক্ষোভকারীরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে শহরের বিভিন্ন অলিগলিতে ঢুকে পড়েন। কিছুক্ষণ পর চৌরঙ্গী মোড়সংলগ্ন সিনেমা হল সড়ক থেকে একদল বিক্ষোভকারী মিছিল নিয়ে এসে পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছুড়তে থাকেন। তখন পুলিশ ধাওয়া দিলে বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ বাধে। একদল বিক্ষোভকারী আহম্মদনগর এলাকায় গিয়ে আহমদিয়া সম্প্রদায়ের অন্তত শতাধিক বাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুর করেন। সন্ধ্যা পর্যন্ত দফায় দফায় এ পাল্টাপাল্টি হামলা চলে।
সংঘর্ষের একপর্যায়ে পুলিশ, বিজিবি ও র্যাবের সদস্যরা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে কাদানে গ্যাসের শেল ও রাবার বুলেট ছোড়েন। পরে প্রশাসনের হস্তক্ষেপে আহমদিয়াদের জলসা বন্ধ ঘোষণা করা হয়।
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: