সুরমার দক্ষিণ তীরে একই ভবনে সিলেট বিভাগীয় কমিশনার ও পুলিশের রেঞ্জ ডিআইজির কার্যালয়। আশপাশে সরকারি-বেসরকারি অনেক প্রতিষ্ঠান, বিসিক শিল্পনগরীও সেখানে। কয়েকদিন আগে বিসিকের ভেতরেও ছিল কোমরপানি।
সিলেট-গোলাপগঞ্জ সড়ক ধরে এক কিলোমিটার দূরেই নগরীর আলমপুর।
সেখানে গুল বেগমের সঙ্গে দেখা। ২১ দিন পানিবন্দি গুল বেগম সাংবাদিক এসেছেন শুনে দিলেন দৌড়!
গুল বেগমের মতো ত্রাণের আশায় নাম লেখাতে ছুটে আসেন বিনা রানী সূত্রধর, সাজন মিয়াসহ কয়েকজন। যদি এবার মেলে ত্রাণ।
আলমপুরে ফরিদ আহমদের বাসার সামনে হাঁটুপানিতে দাঁড়িয়ে ভাড়াটিয়া অনিতা সিংহ, মনি রানী দাসের সঙ্গে কথা হয়। মনি রানী জানান, সুনামগঞ্জের জামালগঞ্জে গ্রামের বাড়িতে অনেক কষ্টে বোরো চাষ করে ১০ মণ ধান ভাড়া বাসায় এনেছিলেন। বন্যার পানিতে সব নষ্ট হয়ে গেছে। অনিতা-মনিদের মতো বাসার সব ভাড়াটিয়া এখনও ঘরের ভেতরে হাঁটুপানিতে দাঁড়িয়ে রান্না করেন। গত ১৪ জুন থেকে পানিবন্দি অবস্থায় ১০ পরিবারের সবাই মানবেতর জীবনযাপন করছেন।
স্থানীয় ব্যবসায়ী আব্দুল করিমের ঘরেও পানি। তিনি বলেন, ২০০৪ সালে সর্বশেষ বন্যায় এই এলাকা প্লাবিত হয়েছিল। দু-তিন দিন পর নেমে গিয়েছিল। এবার পানি নামতেই চাইছে না। এখন পুরো এলাকা যেন যশোরের সেই 'ভবদহ'। ভবদহের মতো আলমপুরের মানুষ দীর্ঘদিন পানিবন্দি। তিনি বলেন, বাড়ির আশপাশে ৫০-৬০ ঘরে পানি রয়েছে। কাউন্সিলর খবর পর্যন্ত নেননি। আশপাশের বন্যার্ত অসহায়-হতদরিদ্র মানুষকে আশ্রয় দিয়েছেন প্রতিবেশীরা। ঘরবাড়ি ডুবে থাকায় প্রায় তিন সপ্তাহ ধরে প্রতিবেশীর বাড়িতে আছে বাবুল মিয়ার পরিবার।
প্রতিদিন কলাগাছ ও টায়ারের তৈরি ভেলায় চেপে বাড়িঘর দেখতে যান বাবুল মিয়া। তিনি বলেন, ঘরের ভেতরে পানি ছিল। ক'দিন সামান্য কমেছে। পানিতে ঘর হেলে গেছে। এভাবে পানি থাকলে পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাই দেখে যাই। পানি না কমলে সংস্কারের উপায়ও নেই। পাড়ার ভেতরের রাস্তা ধরে ভেলায় দুই সন্তানকে নিয়ে আসে রাজমিস্ত্রি সোহেল আহমদ ও রাহেলা বেগম দম্পতি। রাহেলা বলেন, খাবার পানির খুব সমস্যা। কোমরপানি পেরিয়ে খাবার পানি আনতে যেতে হয়।
রিকশাচালক গোবিন্দ হাঁটুপানিতে বাজার নিয়ে বাড়ি ফেরার পথে বলেন, এখানে ত্রাণ নিয়ে এসেছে কেউ, তা দেখিনি। কেউ দেখেছে বলেও শুনিনি। সিএনজি অটোরিকশা চালক সাব্বির বলেন, ৮-৯ বছর ধরে এই এলাকায় রয়েছি। কোনোদিন বন্যা দেখিনি। এবারের প্লাবনে যে দুর্ভোগে পড়েছি, তা ভাষায় বর্ণনা করার মতো নয়।
নগরীর আলমপুরসহ আশপাশের এলাকা সিলেট সিটি করপোরেশনের (সিসিক) ২৭ নম্বর ওয়ার্ডের আওতাধীন। স্থানীয় কাউন্সিলর আজম খান মহানগর আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটিতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেনের পর দ্বিতীয় সদস্য। ওয়ান ইলেভেনের সময় সিসিকের ভারপ্রাপ্ত মেয়র ছিলেন তিনি। তার ওয়ার্ডের চারশ থেকে পাঁচশ মানুষ এখনও পানিবন্দি বলে তিনি স্বীকার করলেও ত্রাণ না পাওয়ার অভিযোগ মানতে রাজি নন। তিনি দাবি করেন, উপদ্রুত সব এলাকায় তিনি গেছেন; ত্রাণও দিয়েছেন। বেসরকারি উদ্যোগেও বিভিন্ন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের ত্রাণ তিনি বিতরণ করার ব্যবস্থা করেছেন।
নগরীর ২৭ নম্বর ওয়ার্ডের মতো নতুন করে বর্ধিত অংশে ৩৯ নম্বর ওয়ার্ডে কয়েকশ মানুষ এখনও পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছেন। এসব এলাকার অনেক পরিবার বাড়িঘর ছেড়ে আত্মীয়-স্বজনের বাসাবাড়িতে থাকছেন বলে জানান মঈন উদ্দিন। তিনি বলেন, ঘরের ভেতরের পানি কমেছে। তবে রাস্তায় পানি রয়েছে। সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির ব্যাপারে কাউন্সিলর আজম খান বলেন, সুরমা নদীর সাইটে পানি কমলেও কুশিয়ারার দিকে বাড়ছে। সিটি করপোরেশনের ত্রাণ মানেই সরকারি ত্রাণ উল্লেখ করে তিনি বলেন, প্রায় ২০ হাজার মানুষের ওয়ার্ডের জন্য দু'দফায় ৪ টন চাল বরাদ্দ হয়েছিল; তা বিতরণ করেছি।
প্রথম দফায় মে মাসের মাঝামাঝি সপ্তাহখানেক পানিবন্দি ছিলেন সিলেটের লাখো মানুষ। এরপর ১৪ জুন থেকে দ্বিতীয় দফায় পানিবন্দি হন আরও বেশি মানুষ। সিলেট রেলওয়ে স্টেশন সংলগ্ন বঙ্গবীর রোডের ব্যবসায়ীরাও পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছেন।
নগরীর পাশাপাশি জেলার বিভিন্ন উপজেলাতেও হাজারো মানুষ এখনও পানিবন্দি। দু'দিন পর সুরমা, কুশিয়ারাসহ এ অঞ্চলের সবক'টি নদনদীতে পানি ফের বাড়ছে। সিলেটে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) উপবিভাগীয় প্রকৌশলী একেএম নিলয় পাশা বলেন, সবচেয়ে বড় সংকট বন্যার পানি নামছে না। ফলে উজানে বৃষ্টি হলেই নদনদীর পানি বাড়ছে। উজানে পাহাড়ি এলাকায় কমবেশি বৃষ্টি হয়। এর প্রভাবে এখানে পানি বাড়ছে। তিনি বলেন, নতুন করে বন্যার পূর্বাভাস নেই। তার পরও মানুষ পানিবন্দি হয়ে আছে। পানি নামতে না পারলে সামান্য বৃষ্টিতেই পানি বাড়বে।
গতকাল সন্ধ্যা ৬টায় পাউবোর দেওয়া সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, সুরমার নদীর পানি কানাইঘাট পয়েন্টে বিপৎসীমার দশমিক ৪২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। এই পয়েন্টে আগের দিনের চেয়ে গতকাল ভোরে ৬ সেন্টিমিটার বেড়ে যায়। অবশ্য সিলেট (নগরী) পয়েন্টে সুরমার পানি কমা অব্যাহত রয়েছে। এদিকে আমলসিদ পয়েন্টে কুশিয়ারা নদীর পানি আগের দিনের চেয়ে ৯ সেন্টিমিটার বেড়েছে। এই প্রতিবেদন লেখার সময় অমলসিদে কুশিয়ারা বিপৎসীমার দশমিক ৬৬ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। শেওলা ও ফেঞ্চুগঞ্জ পয়েন্টে কুশিয়ারার পানি অপরিবর্তিত রয়েছে।
বন্যায় জেলায় ৬৫৪টি আশ্রয়কেন্দ্রে ২ লাখ ৩০ হাজার ৬৩২ জন বন্যার্ত আশ্রয় নিয়েছিলেন। বর্তমানে ৪১৬টি আশ্রয়কেন্দ্রে ৩৫ হাজার ৬৮৫ জন বন্যার্ত রয়েছেন বলে জানান জেলা প্রশাসক মো. মজিবর রহমান। গতকাল দুপুরে জেলার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি সম্পর্কে তিনি বলেন, বন্যায় ৪ লাখ ৮৪ হাজার ৩৮৩ পরিবার দুর্গত। বন্যাকবলিত মানুষের সংখ্যা ২৯ লাখ ৯৯ হাজার ৪৩৩ জন। এই জেলায় বন্যায় ৪০ হাজার ৯১টি ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ২৮ হাজার ৯৪৬ হেক্টর জমি প্লাবিত হয়।
এদিকে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত বাড়িঘর মেরামত ও সংস্কারের জন্য প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ ও কল্যাণ তহবিল থেকে ৫ কোটি টাকা বরাদ্দের কথা জানিয়েছেন জেলা প্রশাসক। তিনি বলেন, আজ সোমবার থেকে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত ৫ হাজার পরিবারকে ১০ হাজার টাকা করে দেওয়া হবে। জেলার বন্যাকবলিত এলাকায় বিতরণের জন্য আরও ৭০ লাখ টাকার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। ৫০ লাখ টাকা চেয়ে মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠিয়েছে জেলা প্রশাসন।
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: