মুজিবনগর সরকার, প্রবাসী সরকার বা অস্থায়ী সরকার- যে নামেই ডাকা হোক না বা পরিচিতি পেয়ে থাক, পঞ্চাশ বছর আগে জাতির জীবনমরণ সন্ধিক্ষণে, অস্তিত্ব ধ্বংসায়োজনের মুহূর্তে সাহসিকতা ও বীরত্বের সঙ্গে প্রতিষ্ঠিত করেছিল বাঙালির স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র। হানাদার কবলিত দেশকে সশস্ত্র লড়াই, রক্ত আর প্রাণের বিনিময়ে মুক্ত করেছে। হাজার বছর ধরে বঞ্চিত, লাঞ্ছিত, শোষিত, নিপীড়িত, ঘুমন্ত ও পশ্চাৎপদ জাতিকে সশস্ত্র সংগ্রামের ভেতর দিয়ে যুদ্ধ জয়ের নিশানায় পৌঁছে দিয়েছিল সাড়ে সাতকোটি মানুষের সমর্থিত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার, সেই একাত্তর সালে।
পঞ্চাশ বছর আগে যখন পাকিহানাদার বাহিনী নির্বিচারে গণহত্যা চালায় বাংলাদেশজুড়ে, প্রতিরোধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল মুক্তিকামী বাঙালি আধুনিক সমরাস্ত্র সজ্জিত বাহিনীর বিরুদ্ধে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে, গ্রেফতার হবার আগে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। দু’দফায় দুটি বার্তায় এই ঘোষণা দেয়া হয়। সত্তরের নির্বাচনে জনগণের বিপুল ভোটে বিজয়ী আওয়ামী লীগ নেতারা সীমান্ত পাড়ি দিয়ে মুক্তাঞ্চলে জমায়েত হন। বিভিন্নস্থানে ছড়িয়ে থাকা গণপরিষদ সদস্যরা ১০ এপ্রিল একত্রিত হন। তাজউদ্দীন আহমদ ৩ এপ্রিল দিল্লীতে ইন্দিরা গান্ধী এবং তার উপদেষ্টাদের সঙ্গে বৈঠক করে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সহায়তা কামনা করেন।
১০ এপ্রিল তাজউদ্দীন আহমদ গণপরিষদের অধিবেশন আহ্বান করেন। প্রায় ২শ জন এমএনএ এবং এমপিএ এই অধিবেশনে উপস্থিত ছিলেন। মুজিবনগর সরকারের প্রথম কেবিনেট সচিব এইচ টি ইমাম কুষ্টিয়া জেলা সীমান্তে এই অধিবেশন বসার উল্লেখ করেছেন, ‘অধিবেশনে সর্বসম্মতিক্রমে মুক্তিযুদ্ধ ও সরকার পরিচালনার জন্য মন্ত্রী পরিষদ গঠিত হয়। এই মন্ত্রী পরিষদ এবং এমএনএ ও এমপিএগণ ১০ এপ্রিল বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রপতি করে সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ঘোষণা করা হয়।’
বাঙালির প্রথম স্বাধীন সার্বভৌম সরকার। এই বৈঠকেই বঙ্গবন্ধুর ২৬ মার্চ ঘোষিত স্বাধীনতার ঘোষণাসহ স্বাধীনতার সনদপত্র আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা ও অনুমোদন করা হয়। দেশের নামকরণ করা হয় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ। এর পরদিন জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া ভাষণে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ বলেছিলেন, ‘যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হবে না বলে স্থির বিশ্বাস।’ বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যাবার আহŸান জানান তিনি। সরকার গঠনের পর শপথ গ্রহণের আনুষ্ঠানিকতার আয়োজন করা হয় ১৭ এপ্রিল। সেদিন বাঙালি জাতির ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় রচিত হয়েছিল। অসংখ্য সাংবাদিক; বেতার-টিভি প্রতিনিধি, আমন্ত্রিত অতিথি এবং ব্যাপক জনসমাগমের মধ্যে প্রজাতন্ত্রের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রীপরিষদ শপথ নিয়েছিল। শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা পাঠ করা হয়। এই ঘোষণার ভিত্তিতে বাংলাদেশের সংবিধান পরবর্তীকালে রচিত হয়। কেবিনেট সচিব এইচ টি ইমাম এর মতে, ‘স্বাধীনতা ঘোষণাপত্র হলো আমাদের ম্যাগনাকার্টা, স্বাধীনতার সনদ।
এই ঘোষণায় সুস্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে কেন, কোন্ ক্ষমতার বলে এবং পরিস্থিতিতে একটি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা হলো, যে রাষ্ট্রের নাম হলো গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ। যেহেতু এই সরকার মুজিবনগরে তার প্রধান দপ্তর স্থাপন করেছিল তাই এর ব্যাপক পরিচিতি হলো ‘মুজিবনগর সরকার’ রূপে। স্বাধীনতাযুদ্ধ চলাকালে এই সরকারের প্রধান কার্যালয় কলকাতায় স্থাপন করা হয় প্রধানত নিরাপত্তা এবং মুক্তিযুদ্ধে নির্বিঘেœ নেতৃত্ব দেয়ার কারণে।’ বাংলাদেশের আনুষ্ঠানিক; বিধানিক, সর্বোপরি শাসনতান্ত্রিক রূপরেখাও বিধৃত হয়েছে এই সনদপত্রে। আর এই সনদপত্রের ভিত্তিতেই সরকার গঠিত হয়েছে। যার ছিল আইনানুগ বৈধতা। কারণ, এই ঘোষণাপত্রে জনগণের অভিপ্রায় উঠে এসেছে। যে জনগণ তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিকে সর্বোময় ক্ষমতা প্রদান করেছে ব্যালটের মাধ্যমে।
নির্বাচিত সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে সত্তরের নির্বাচনে নির্বাচিত গণপরিষদ সদস্যদের দিয়েই বাংলাদেশের প্রথম সরকার গঠিত হয়। বৈধভাবে গঠিত বলেই এই সরকার আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্যতা পায়। বিদেশী রাষ্ট্রগুলোও এই সরকারকেই স্বীকৃতি দেয়। আর এই সরকারের ভিত্তিতেই ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ২৬ মার্চের স্বাধীনতা ঘোষণা। যা ১৭ এপ্রিল বিশ্ববাসীর কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে তুলে ধরা হয়েছিল। এই ঘোষণার ভিত্তিতেই সাড়ে সাতকোটি মানুষ রণাঙ্গণে নেমেছিল, শত্রুকে নিশ্চিহ্ন করে দেশের প্রতিটি ইঞ্চি মাটিকে স্বাধীন ও নিরাপদ রাখার লক্ষ্যে। এই চেতনা মানুষের মধ্যে গড়ে তুলেছিলেন বঙ্গবন্ধু। প্রথম সরকারের রাষ্ট্রপতি। যিনি পাকিস্তানের ২৩ বছরের ইতিহাসে জেলজুলুম, নির্যাতন, হুলিয়া, মৃত্যুদÐ, ফাঁসির মঞ্চ পেরিয়ে জাতিকে তিলে তিলে গড়ে তুলেছিলেন স্বাধীনতা ও মুক্তির সংগ্রামে। এক সময় আঘাত আসে আর প্রত্যাঘাতে বঙ্গবন্ধু জাতিকে সশস্ত্র সংগ্রামের জন্য উদ্বুদ্ধ করেন। আর পুরো নয়মাস বাঙালি জাতি শেখ মুজিবের নামে, তারই নির্দেশে স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। আত্মদান করেছিল।
একাত্তরের ৭ মার্চের ভাষণের দিক নির্দেশনা ও ২৬ মার্চের বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার ভিত্তিতে বাঙালি প্রতিরোধ যুদ্ধে নেমেছিল। ‘যার যা আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা’ অবশ্য করেছিল। সেই পথ ধরেই ১০ এপ্রিল সরকার গঠন আর ১৭ এপ্রিল সেই সরকারের শপথ গ্রহণ- বাঙালির ইতিহাসের এক যুগান্তক্ষণ। ১৭ এপ্রিলের সকালে মুজিবনগরে থোকা থোকা ধরে থাকা আমগাছের নিচে মঞ্চে দাঁড়িয়ে শপথ পাঠ করেন মন্ত্রিপরিষদ সদস্যরা। জাতীয় সংগীত গাওয়া হয়। স্থানীয় লোকজন অনুষ্ঠান আয়োজনে ছিল সহায়। তারাই মঞ্চের জন্য বেঞ্চি, চেয়ার, টেবিল সরবরাহ করেছিল। শপথ গ্রহণ শেষে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম এক সংক্ষিপ্ত ভাষণে মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট তুলে ধরে বলেছিলেন, ‘পৃথিবীর মানচিত্রে আজ যে নতুন রাষ্ট্রের সূচনা হলো তা চিরদিন থাকবে। পৃথিবীর কোন শক্তি তা মুছে দিতে পারবে না।’ না পারেনি। তাই আজ পঞ্চাশ বছর পরও স্মরণ করা যায়, সেদিনের সেই ঐতিহাসিক মুহূর্ত ও তার আবেদন।
বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে তাকে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করতে হয়। ব্যাখ্যা হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন, ‘আপনারা জানেন, পাকিস্তানের শোষণ এবং শাসন থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য গত ২৩ বছর ধরে বঙ্গবন্ধু সর্বস্বার্থ পরিত্যাগ করে আন্দোলন করেছেন। তিনি চেয়েছিলেন রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক অধিকার। আমি জোর দিয়ে বলছি, তিনি আমাদের মধ্যে আছেন। জাতির সংকটের সময় আমরা তাঁর নেতৃত্ব পেয়েছি।... আমাদের রাষ্ট্রপতি জনগণ-নন্দিত ক্ষণজন্মা মহাপুরুষ, নির্যাতিত মানুষের মূর্ত প্রতীক শেখ মুজিব। বাংলার মানুষের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অধিকারের জন্য সংগ্রাম করে আজ বন্দি।
তার নেতৃত্বে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম জয়ী হবেই।’ এই আশারবাণী আলোকিত মহিমা হয়ে বিজয় ছিনিয়ে এনেছিলো নয়মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে। একাত্তরের ১৭ এপ্রিল যে সাহস, যে উদ্যম, যে মনোবল নিয়ে সাড়ে সাতকোটি মানুষের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা সরকার গঠন করেছিলেন, তার দ্বিগুণ মনোবল নিয়ে তা পরিচালনা শুধু নয়, বিশ্ব জনমতও তৈরি করেছিলেন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে। মুক্তিবাহিনী সংগঠিত করে যুদ্ধ পরিচালনা এবং স্বল্প সময়ে দেশকে হানাদারমুক্ত করেছিলেন। পৃথিবীর ইতিহাসে আর কোন দেশ যুদ্ধ করে এতো স্বল্প সময়ে দেশকে স্বাধীন করতে পারেনি।
১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের আম্রকাননে বাঙালি নামে একটি নতুন জাতি বিশ্বজাতি সভায় আসন নিলো জন্মের সাথে সাথেই। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেছেন ও, ‘বিগত বহু বৎসর যাবৎ বাংলার মানুষ, তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি, নিজস্ব ঐতিহ্য, নিজস্ব অধিকার নিয়ে এগুতে চেয়েছেন, কিন্তু পাকিস্তানী কায়েমী স্বার্থ কখনই তা হতে দিল না। ওরা আমাদের ওপর আক্রমণ চালিয়েছে। আমরা নিয়মতান্ত্রিক পথে এগুতে চেয়েছিলাম, ওরা তা দিল না। ওরা আমাদের ওপর বর্বর আক্রমণ চালাল। তাই আজ আমরা লড়াইয়ে নেমেছি’। সারাদেশজুড়ে বাঙালি মুক্তিযোদ্ধারা তখন পাকিবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধে সক্রিয়। বহু এলাকায় পাকবাহিনী তখনো অনুপ্রবেশ করতে পারেনি। মুক্তাঞ্চলে সংগঠিত হচ্ছিল সামরিক, বেসামরিক বাঙালিরা। শপথকালে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি অত্যন্ত আশাবাদী বলেই দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছিলেন, ‘এ লড়াইয়ে আমাদের জয় অনিবার্য। আমরা পাকিস্তানী হানাদারদের বিতাড়িত করবোই।
আজ না জিতি কাল জিতব। কাল না জিতি পরশু জিতবই। আমরা বিশ্বের সব রাষ্ট্রের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান চাই। পরস্পরের ভাই হিসেবে বসবাস করতে চাই। মানবতার, গণতন্ত্রের এবং স্বাধীনতার জয় চাই।’ স্বাধীনতা অবশ্যই এসেছিল এবং তাদের নেতৃত্বেই। যারা ১৭ এপ্রিল শপথ নিয়ে জনগণকে দেয়া অঙ্গীকার ও প্রতিশ্রæতি যথাযথভাবে পালন করেছেন। আর এই কাজে দেশ ও জাতীয় নেতাদের সহায়ক শক্তি হিসেবে ছিলেন প্রশাসনের কর্মকর্তারা । প্রথম সরকারের প্রথম কেবিনেট সচিব এইচ টি ইমাম মূল্যায়ণ করেন যে, ‘...কী অসাধারণ নেতৃতে অসম্ভবকে সম্ভব করেছিলেন এই সরকার, তাও মাত্র নয় মাস সময়ে। অবশ্যই এটি সম্ভব হয়েছিল দেশপ্রেম ও গণসমর্থনের কারণে। কোন দেশের জনগণের এতো বড় অংশকে এমন ব্যাপকভাবে সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে দেখা যায়নি।
এই দেশপ্রেম, ত্যাগ, মুক্তি কামনাকে সঠিকখাতে প্রবাহিত করে দেশ ও বিদেশে সমর্থনের ব্যবস্থা করে স্বাধীনতা অর্জন করাই ছিল আমাদের বিপ্লবী প্রবাসী সরকারের সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব।.... সরকার আকারে বিশাল ছিল না; কিন্তু অত্যন্ত কার্যকর এবং দক্ষ ছিল।’ পঞ্চাশ বছর আগে গঠিত বাঙালির প্রথম সরকারের একটাই লক্ষ্য ছিল, যুদ্ধে জয়লাভ করা। অর্থাৎ বাংলাদেশকে সম্পূর্ণ হানাদার মুক্ত করা। এবং সেই লক্ষ্যেই তারা তাদের সম্পূর্ণ শক্তি নিয়োগ করেছিলেন। প্রচুর প্রতিকূলতার ভেতর দিয়ে যুদ্ধ পরিচালনা করেছেন। শেষতক বিজয় ছিনিয়ে এনেছেন।
১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল বিশ্ববাসীর উদ্দেশ্যে দেয়া বিবৃতিতে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ বলেছিলেন ‘লাশের পাহাড়ের নীচে পাকিস্তান আজ মৃত ও সমাহিত।’ এই সরকারের লক্ষ্য ছিল স্বাধীনতা অর্জন এবং বঙ্গবন্ধুর মুক্তি সাধন। সেই লক্ষ্য থেকে সরকার কখনো বিচ্যুত হয়নি। সেই লক্ষ্যকে বাস্তবায়িত করতে নয় মাসে সরকারের নেতৃত্বে যা অর্জিত হয়েছিল, তা অসামান্য। এই সরকারের পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য ড. আনিসুজ্জামানের মতে, বাংলাদেশের সমস্ত মুক্তিযোদ্ধাদের পুনর্গঠন, রণাঙ্গনের বিভিন্ন সেক্টর ও ফোর্সের বিন্যাস, সামরিক নেতৃত্বের পূর্বাপর ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা একদিকে, অন্যদিকে সরকারের বেসামরিক সংগঠন, বেসামরিক অঞ্চল গঠন ও সেখানে প্রশাসন গড়ে তোলা; যুব ক্যাম্প গঠন, মুুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সকল রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে পরামর্শক কমিটির প্রতিষ্ঠা, ভারত সরকারের সাহায্য নিয়ে প্রায় এক কোটি শরণার্থীর দেখাশোনা ; কূটনৈতিক তৎপরতা চালানো এবং যৌথ সামরিক কমান্ড গঠন।
প্রবাসী বাঙালিদের সাহায্য নিয়ে বিভিন্ন দেশে মুক্তিযুদ্ধের অনুকূলে জনমত গঠন। বিভিন্নদেশে বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য ঘোষণাকারী কূটনীতিবিদদের ব্যবস্থা করা, কলকাতায় বাংলাদেশের মিশন স্থাপন, দিল্লী ও অন্যত্র বাংলাদেশ তথ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠা। মুক্ত এলাকায় বেসামরিক প্রশাসন চালনো, স্বাধীন বাংলা বেতার পরিচালনা ও সরকারি মুখপাত্রের প্রকাশনা, পরিকল্পনা কমিশন গঠন ইত্যাদি। অনেক বিরূপ প্রচার চলেছে সরকারের বিরূদ্ধে, তাছাড়া সরকারের মধ্যেই ষড়যন্ত্রকারী ছিল। তারা চেয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্য নিয়ে পাকিস্তানের সঙ্গে আপোষরফা করতে। এমন প্রয়াস বন্ধ করতেও সরকারের শক্তি ও সময়ের অপচয় হয়। ভারতের উপর নির্ভরশীল হয়েও একটা সম্মানজনক অবস্থা থেকে ভারত সরকারের সঙ্গে আলাপÑআলোচনা চালানো সামান্য কাজ ছিল না।
উপস্থিত দেশী-বিদেশী সাংবাদিকদের জন্য প্রদত্ত বিবৃতিতে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ বলেন, ‘ইয়াহিয়া খান তথা পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী বাঙালিদের রক্ত দিয়ে ধ্বংসের ইতিহাস লিখেছে। গণহত্যা চালাচ্ছে এবং পরাজয় নিশ্চিত জেনে ‘পোড়া মাটি’ নীতি অনুসরণ করছে।” তাজউদ্দীন আহমদ দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করেন যে, “স্বাধীন বাংলাদেশ আজ বাস্তব সত্য এবং এ সম্বন্ধে পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর মনে যেন কোনো সন্দেহ না থাকে। সাড়ে সাত কোটি বীর বাঙালি আজ তাদের স্বাধীন সার্বভৌম সত্তা প্রতিষ্ঠা করেছে এবং যে কোনো মূল্যে তা রক্ষা করবে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবরের নেতৃত্বে সৃষ্ট স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশ পৃথিবীর মানচিত্রে স্থাপিত হয়েছে এবং কোনো শক্তিই আর তা মুছে ফেলতে পারবে না।’
তিনি জোরালো ভাষায় রুশ, আমেরিকা, চীন, ভারতসহ বিশ্বের ছোট-বড় সব দেশের সরকার ও জনগণের কাছে সাড়ে সাত কোটি নিরস্ত্র বাঙালির মরণপণ স্বাধীনতা সংগ্রামে সাহায্যের জন্য আহ্বান জানালেন। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ তার ঘোষণায় আরো বলেন, ‘বাংলাদেশ কোন জোটভুক্ত হবেনা এবং প্রকৃত গণতন্ত্র হবে বাংলাদেশের মূল রাষ্ট্রীয় নীতি। নবজাত এই রাষ্ট্রকে স্বীকৃতিদানের জন্য তিনি বিশ্বের সকল রাষ্ট্রের প্রতি আহ্বান জানান। সেই সাথে সাড়ে সাতকোটি দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন বলেন যে, ‘জাতি আজ দৃঢ় প্রত্যয়ের সাথে পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর নৃশংসতম তৎপরতা প্রতিরোধ করছে এবং শত্রু পরাজিত ও বিতাড়িত না হওয়া পর্যন্ত আমাদের যুদ্ধ চলবে।’
পঞ্চাশ বছর পর একাত্তরের ১৭ এপ্রিল শপথ নেয়া সরকারের পরবর্তী কার্যক্রম মূল্যায়ণে স্পষ্ট হয়, বাঙালি জাতির প্রথম সরকার বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদেশ রাষ্ট্র এবং বাঙালি জাতিকে ঠাঁই করে দিয়েছেন কেবল নয়, একটি আনুষ্ঠানিক সমরসজ্জার সামরিক বাহিনী, পেছনে যার মার্কিন ও চীন সমর্থন নিয়ে দন্ডায়মান, সেই সরকারের লক্ষাধিক সেনার বিরুদ্ধে সশস্ত্র লড়াই করতে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করেছিল প্রথম সরকার। এই সরকারের পথ ছিল বাঙালি জাতির মুক্তির দিগন্ত তৈরি। পঞ্চাশ বছরে সে পথ পাবার সুযোগও মেলেনি। বিজয়ের সাড়ে তিন বছরের মাথায় ৬ সদস্যের সরকারের ৫ জনই নির্মমভাবে নিহত হন অপর সদস্যের পরিকল্পনা, পরিচালনায়। যিনি স্বাধীনতা নয়, পাকিস্তানের সঙ্গে কনফেডারেশন চেয়েছিলেন যুদ্ধকালে। এই সদস্যকে কেন্দ্র করে মুজিবনগর সরকারের ভেতর একটি চক্র গড়ে ওঠে। এরা মার্কিন-পাকিস্তান মদদপুষ্ট হয়ে একাত্তরে স্বাধীনতার সংগ্রামকে ভ্রান্ত পথে নেবার তৎপরতা চালায়। স্বাধীনতা পরবর্তীসময়ে এই চক্র আঘাত হানে বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর উপর। সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। পঁচাত্তরের ৩ নভেম্বর জেলখানায় হত্যা করা হয় সৈয়দ নজরুল, তাজউদ্দীন, কামারুজ্জামান এবং মনসুর আলীকে। এঁরাই ছিলেন একাত্তরে বাঙালি জাতির কর্ণধার। পরাজিত শক্তি তাঁদের উপর আঘাত হানে। ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর দিবসে তাদের কথা মনে আসে বেশি।
একাত্তরের ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর সরকারের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা ও শপথ গ্রহণ যুদ্ধরত বাঙালির জীবনে স্বাধীনতা ও মুক্তির স্বপ্ন বাস্তবায়ন ত্বরান্বিত করেছে। সংক্ষিপ্ততম যুদ্ধের ভেতর দিয়ে বাঙালি তার স্বাধীন সার্বভৌম ভূ-খন্ড অর্জন করেছিল। ১৭ এপ্রিল বিশ্ববাসীকে জানান দিয়েছে, জনগণের অধিকারকে সামরিক নিপীড়ন, হত্যাযজ্ঞ চালিয়েও নিশ্চিহ্ন করা যায় না। জনগণের অভিপ্রায় একটি দন্ডে এসে মিলিত হলে শত্রু পথ হারাবেই। কৃষক শ্রমিক ছাত্র শিক্ষক বুদ্ধিজীবী পেশাজীবী নারীসহ সকলেই জন্মভূমি মাতৃভূমিকে শত্রু মুক্ত করার প্রতিজ্ঞা নিয়ে মুক্তিবাহিনীতে পরিণত হয়েছিল।
শত্রু হননে মত্ত হয়ে তারা দেশকে হানাদারমুক্ত করতে জীবনপণ বাজি রেখেছিল। বীর বাঙালি অস্ত্র হাতে বিজয়ের বেশে ঘরে ফিরেছে। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পরও তাই এই দিনটি মর্যাদাপূর্ণ। মুজিব নগর সরকারের সুবর্ণ জয়ন্তীকালে আমরা স্মরণ করতে পারি মেহেরপুরের আম্রকাননে বাঙালি জাতির উত্থানপর্বকালকে। আলো হাতে এসেছিলেন বাঙালির প্রাণপ্রিয় মানুষেরা। বিজয় পতাকা হাতে ফিরেছিল কতো যোদ্ধা। সবই আজ ইতিহাসের পাতায় পাতায় সন্নিবেশিত হয়ে আছে।
লেখক: জাফর ওয়াজেদ, একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক ও মহাপরিচালক, প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ (পিআইবি)
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: