পৃথিবীর ইতিহাসে একটা জাতি তথা ভূখন্ডের স্বাধীনতার পেছনে নেতৃস্থানীয় প্রত্যক্ষ ভূমিকা আছে, এমন বিশ্ববিদ্যালয় আর দ্বিতীয়টি নেই। তাছাড়াও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ই পৃথিবীর বুকে এক অনন্য নজির যে কিনা একটা জাতিকে দু'বার পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে সগৌরবে বাঁচিয়েছে।
ব্রিটিশ পরবর্তী সময়েও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আলোয় আলোকিত হয়ে একটি দেশ পেয়েছিল-
ভাষা(১৯৫২),
শিক্ষা(১৯৬২),
স্বাধীনতা(১৯৭১)
সে আলোয় আলোকিত আজকের সোনার বাংলা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠালগ্নের ইতিহাসও এক বিশাল বীরত্ব গাঁথা। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনকালে স্বাধীন জাতিসত্ত্বার বিকাশের লক্ষ্যে বিশ শতকের দ্বিতীয় দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়া শুরু হয়। ব্রিটিশ ভারতে তৎকালীন শাসকদের অন্যায্য সিদ্ধান্তে পূর্ববঙ্গের মানুষের প্রতিবাদের ফসল হচ্ছে এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। এ সম্পর্কে প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুন 'ঢাকা স্মৃতি বিস্মৃতির নগরী' গ্রন্থে লিখেছেন, "বঙ্গভঙ্গ রদের ক্ষতিপূরণ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। লর্ড লিটন যাকে বলেছিলেন স্প্লেনডিড ইম্পিরিয়াল কমপেনসেশন। পূর্ববঙ্গ শিক্ষাদীক্ষা, অর্থনীতি সব ক্ষেত্রেই পিছিয়ে ছিল। বঙ্গভঙ্গ হওয়ার পর এ অবস্থার খানিকটা পরিবর্তন হয়েছিল, বিশেষ করে শিক্ষার ক্ষেত্রে।"
১৯১২ সালের ২ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দেন তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জ। এর মাত্র তিন দিন পূর্বে ভাইসরয় এর সাথে সাক্ষাৎ করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আবেদন জানিয়েছিলেন ঢাকার নবাব স্যার সলিমুল্লাহ, ধনবাড়ীর নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী, শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক এবং অন্যান্য নেতৃবৃন্দ।
১৯১৩ সালে প্রকাশিত হয় নাথান কমিটির ইতিবাচক রিপোর্ট এবং সে বছরই ডিসেম্বর মাসে সেটি অনুমোদিত হয়। ১৯১৭ সালে গঠিত স্যাডলার কমিশনও ইতিবাচক প্রস্তাব দিলে ১৯২০ সালের ১৩ মার্চ ভারতীয় আইন সভা পাশ করে 'দি ঢাকা ইউনিভার্সিটি অ্যাক্ট (অ্যাক্ট নং-১৩) ১৯২০'।
তারপরের গল্প রুপকথার ফিনিক্স পাখির মতো পুরো বাংলার কন্ঠস্বরের নির্বিরোধ প্রতিচ্ছবি-ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ১৯১৪ সালের প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ডামাডোলের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা কিছু টা স্থিমিত হলেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ই এই বিশ্ববিদ্যালয়ের আশেপাশেই যুদ্ধরত অনেক সৈনিকরাই অস্থায়ী ক্যাম্প স্থাপন করেছিল। সাতচল্লিশের দেশভাগের আন্দোলন ত্বরান্বিত হয়েছিল তেতাল্লিশের দুর্ভিক্ষের ভয়াবহতায়। এই দুর্ভিক্ষের সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অগ্রণী ভূমিকা রেখেছিলো।
সাতচল্লিশের দেশভাগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান সম্পর্কে বলতে গিয়ে অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খান বলেন, "ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হয়েছে ঔপনিবেশিক শাসনের শেষদিকে। এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ২৭ বছর পর এদেশে ব্রিটিশ শাসনের অবসান হয়েছে। তখন এই অঞ্চল পাশ্চাৎপদ ছিল। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তার প্রতিষ্ঠার অল্প সময়ের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে,"।
বায়ান্নর ভিতও রচিত হয়েছিল এই বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নিগ্ধ, তপ্ত রাজপথে। ১৯৪৭-৫২ পাঁচ বছরের সুদীর্ঘ আন্দোলনের সফলতার মঞ্চ ছিলো এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ১৯৬২ 'র আইয়ুব খানের অবৈধ শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে সমস্বর কন্ঠস্বরের উত্তাপ ছড়িয়েছিল এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। অব্যাহত আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ১৯৬২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হল থেকে ছাত্রদের একটি বিক্ষুব্ধ মিছিল আব্দুল গণি রোড হয়ে অগ্রসর হলে পুলিশ পেছনে থেকে অতর্কিতে মিছিলের ওপর গুলিবর্ষণ করে। ঐ দিন পুলিশের গুলিতে বাবুল, মোস্তফা, ওয়াজিউল্লাহ শহীদ হন। সারা দেশে পুলিশ ও ইপিআর-এর নির্যাতন ও গুলিতে বহু ছাত্র-জনতা আহত হয়। পরবর্তীতে আইয়ুব খান বাধ্য হয় শিক্ষানীতি পুনর্গঠনে।
পরবর্তী তে '৬৬ র ৬ দফা, '৬৯ র গনঅভ্যুত্থান, '৭০ র নির্বাচন, ঐতিহাসিক ৭ মার্চের প্রেক্ষাপট সহ সকল আন্দোলনের সূতিকাগার ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটও রচিত হয়েছিল এই বিশ্ববিদ্যালয়ের পবিত্র ভূমিকে রক্তাক্ত করে। ২৬ মার্চের কালো রাত্রিতে পাকিস্তানি নরপিশাচরা তাই প্রথম হামলা টা করেছিল সার্জেন্ট জহুরুল হক, জগন্নাথ হল, রোকেয়া হল সহ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটা আঙ্গিনায়। এদিন বিশ্ববিদ্যালয় আঙ্গিনায় প্রায় তিনশতাধিক শুধু শিক্ষার্থীই নিহত হয়। এছাড়াও ৯ জন শিক্ষক ও অসংখ্য কর্মচারী নিহত হয়।
একাত্তরের ১৪ ডিসেম্বর ঘাতকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০ জন মেধাবী শিক্ষককে হত্যার মাধ্যমে কার্যত বাঙালির নিউক্লিয়াসখ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরই মেরুদণ্ড ভাঙতে চেয়েছিল। মহান মুক্তিযুদ্ধে সহস্রাধিক শিক্ষক, শিক্ষার্থী, কর্মচারী সহ বহু আত্মদান এই বিশ্ববিদ্যালয়কে এক অনন্য উচ্চতায় আসীন করেছে বাঙালির হৃদয়মাঝে।
পচাত্তরের আগস্টের জাতির পিতা মুজিব হত্যার প্রতিবাদে প্রথম সামষ্টিক আন্দোলন হয় এই বিশ্ববিদ্যালয়েই। পরবর্তীতে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন, ১/১১ এর সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিরুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে সহস্র বছর।
এভাবেই একটা বিশ্ববিদ্যালয় একটা জনপদের কন্ঠস্বরের প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠতে পেরেছে শতবর্ষ ধরে।
লেখকঃ সাবেক শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: