অল্প কিছুদিন হলো আমি একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেছি। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালীন সবসময় স্বপ্ন দেখতাম শিক্ষক হবো ও নিজের অর্জিত জ্ঞান ছাত্রদের মাঝে ছড়িয়ে দিয়ে ছাত্রদের মাঝে নতুন জ্ঞান আবিস্কার করবো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালীন সময় কিছু শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষক পেয়েছিলাম যাদের আর্দশ ও নৈতিকতা সবসময় আমাকে অনুপ্রাণিত করতো। বইয়ের পাতায় আমি আব্দুর রাজ্জাক স্যার, আনিসুজ্জামান স্যার, আর.সি দত্ত স্যার, নাজমুল করিম স্যার সম্পর্কে জেনেছি। যখন তাদের বিষয়ে পঠিত করতাম তখন গায়ের লোমগুলো এমনিতে দাড়িয়ে যেত, তারা কি পরিমান জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন। কি পরিমান আর্দশ ও নৈতিকতার চর্চা ছিল তাদের ভেতর।
আজকের লেখাটা লেখলাম আমাদের শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষক আব্দুর রাজ্জাক স্যারের পিএইচডি থিথিস (ইউনিভার্সিটি প্রেস) থেকে প্রকাশিত পড়ার পর। কি অসাধারণ জ্ঞান, কি অসাধারণ গবেষক ছিলেন তিনি কিন্তু বর্তমান সময়ে আমরা কয়জন শিক্ষক গবেষণায় জড়িত এবং গবেষণার মান উন্নয়নে আমরা কি ছাত্রছাত্রীদের কতটুকু প্রকৃত শিক্ষা দিচ্ছি। বর্তমান বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে গুনগত ও মানসম্মত শিক্ষকের অনেক অভাব।প্রাচীনকালে ভারতে ব্রাহ্মণদের তিনটি কর্তব্য ছিল যজন,যাজন ও অধ্যাপন। যজন মানে প্রার্থনা বা ধর্ম পালন করা এবং যাজন মানে অন্যের প্রার্থনা বা ধর্ম পালনে সাহায্য করা আর অধ্যাপন মানে শিক্ষার্থীকে পাঠদান করা। এর আলোকে আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কাজ হলো তিনটি যথা অধ্যাপনা করা, নিজে গবেষণা করা ও শিক্ষার্থীদের গবেষণা কাজে সহায়তা করা। অনেক অধ্যাপক গবেষণার স্বার্থে অধ্যাপনাকে অবহেলা করেন আবার অনেকে গবেষণার স্বার্থে অধ্যাপনাকে অবহেলা করে কিন্তু তারা জানেনা গবেষণা ও অধ্যাপনা দুইটি একই মুদ্রার এপিঠ ও ওপিঠ। ভালো শিক্ষক হলে তাকে ভালো গবেষক হওয়ার চেষ্টা করতে হবে এবং ভালো গবেষক হলে তাকে ভালো শিক্ষক হতে হবে।
সফল ও আনন্দদায়ক অধ্যাপনা থেকেই সৃষ্টি হয় আগামীদিনের গবেষক ও অধ্যাপক সুতরাং কোন অজুহাতে শিক্ষকদের গবেষণাকে অবহেলা করা কি উচিৎ হবে। শিক্ষকতা পেশাতে যোগদানের পর প্রায় লক্ষ্য করি দেশে যোগ্য মেধাবী শিক্ষক ও গবেষক বড় প্রয়োজন। পৃথিবীতে বিশ্ববিদ্যালয় গুলোর যে ক্রম সাজানো হয় তার বড় ভিক্তি হল গবেষণা ও তত্ত্ব আবিস্কার করা।আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় গুলোর সেরা বিশ্ববিদ্যালয় গুলোর ভেতর না থাকার অন্যতম কারন হল গুনগত গবেষণা ও জ্ঞানের তাত্ত্বিক উন্নয়নের অভাব যার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কারন হলো প্রকৃত পরিবেশ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের পড়াশুনা ও গবেষণা নিয়ে উদাসীনতা। আমার ভাবনা কিছু মানুষ ভালো শিক্ষক হওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে জন্ম নেন এবং প্রয়োজনীয় সুযোগ, প্রশিক্ষণ ও অভিজ্ঞতায় জারিত হলে এই মানুষগুলো প্রাতঃস্মরণীয় শিক্ষকে পরিণিত হতে পারে। আমরা কি সেই প্রয়োজনীয় সুযোগ ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করছি নিজেকে প্রশ্ন করি?
আমরা যদি প্রাচীন আধুনিক ও মধ্যযুগের দিকে লক্ষ্য করি সব যুগে ভালো শিক্ষকদের ও গবেষকদের অভাব ছিল। শিক্ষক হওয়ার কথা যাদের না যদি ভুলবশত নিছক ভাবে এমন ব্যক্তিরা শিক্ষকতা পেশায় চলে আসে তাহলে আদৌ কি ভালো শিক্ষা ও গবেষণার নির্দেশনা পাবে তা একটু ভাবনার বিষয় রাখে। বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে এমন অযোগ্য শিক্ষকদের ব্যর্থ মিলনের দুঃসহ ফল ভোগ করতে হয় ছাত্রদের যা দেশে ও বিদেশে অহরহ। বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে ভালো ফলাফল করা ছাত্রদের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেয় কিন্তু একজন ভালো ফলাফলকারী ছাত্র ভালো শিক্ষক ও গবেষক হবে তার নিশ্চয়তা কি? একজন ভালো রেজাল্ট ধারী সবসময় ভালো শিক্ষক ও গবেষক হয়না কারন নিজে সবকিছু সহজে বুঝে যাওয়ার কারনে সে বুঝতে চায় না তার পঠিত বিষয় কতটুকু গ্রহন করেছে এববং কতটুকু নিতে পেরেছে। একজন ভালো শিক্ষক ও গবেষক একজন উঁচুদরের অভিনেতা হতে হবে কারন শিক্ষকতা হলো অনেকাংশ পারফর্মিং আর্ট।দুঃভাগ্যের বিষয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভালো শিক্ষক ও গবেষক পাওয়া দূবির্ষহ। একজন ভালো শিক্ষক ও গবেষক নতুন নতুন জ্ঞান আবিস্কার করবে,প্রচুর পরিমাণ বই পড়ার অভ্যাস থাকবে, সহকর্মীদের সাথে জ্ঞানের চর্চা করবে, গবেষণা ও পাঠদানের বিষয়ে নিজেদের অভিজ্ঞতা শেয়ার করবে এবং ছাত্রদের বাস্তবধর্মী ও গবেষণালব্ধ জ্ঞানের শাখাকে প্রসারণে ভূমিকা রাখতে হবে।
আমরা কি পাচ্ছি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একজন শিক্ষক হিসেবে, এক সহকর্মী অন্য সহকর্মীকে প্রতিযোগী ভাবতে শিখছি এবং কেউ যদি ভালো গবেষণা ও পাঠদান করাতে চাই তাহলে তাঁকে কি ভাবে দমিয়ে রাখা যায় সেই চিন্তায় আমরা সারাদিন মগ্ন থাকি। শিক্ষকদের বলা হয় জাতির আর্দশ, জাতি তাদের অনুসরণ করবে এবং জাতি তাদের কাছ থেকে অনেক কিছু অর্জন করবে।বাংলাদেশর স্বাধীনতার পর আমাদের জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান ৭৩ এর বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন প্রনয়নের মাধ্যমে শিক্ষকদের জন্য সব সুযোগ সুবিধার বিধান করে দিয়েছিলেন কিন্তু আমরা কি তার সেই সোনার বাংলা বির্নিমানে কতটুকু ভুমিকা রাখছি এটা প্রশ্নের বিষয়।বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের উচিৎ গবেষণা ও ভালো পাঠদানের মাধ্যমে গবেষণালদ্ধ জ্ঞানকে প্রসারের মাধ্যমে দেশে তরুণদের জন্য গুনগত শিক্ষা নিশ্চিত করা যাতে ত্রিশ লক্ষ শহীদের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের বাংলাদেশ বিশ্বের বুকে আবারও পরিচয় রাখুক তাদের মেধা ও মননশীলতা দিয়ে।
লেখকঃ
উন্নয়ন গবেষক ও প্রভাষক
বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়,জামালপুর।
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: