ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালীন সবসময় দক্ষিণবঙ্গের বন্ধুদের কথা বলার এক মূহুর্তে তাদের মুখে ঘন মেঘ ছেয়ে যেতো তখন তারা প্রায় বলতো (মাওয়া-জাজিরা) অর্থাৎ পদ্মা নদী পাড়ি দিয়ে যেতে হয় তাদের গ্রামের বাড়িতে। ফেরি পার হতে যা সময় লাগতো তার থেকে দুইগুণ সময় তাদের ফেরির পারাপারের জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছে। ঈদের সময় আমার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে বললাম,“বন্ধু বাড়ি যাবা না"? সেদিন প্রতিউত্তরে আমাকে বলেছিল, “সারারাত ঘাটে ফেরির জন্য বসে থাকতে ভালো লাগে না, তাই এই ঈদে বাড়ি যামুু না।
২৫ জুন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বহুল কাঙ্খিত পদ্মাসেতুর শুভ উদ্ভোধন করবেন। পদ্মা সেতু উদ্বোধন পত্রিকায় পড়ার সময় আমার বন্ধুর সেদিনের বিষাদভরা কণ্ঠে বলা কথাটি মনে পড়ে গেল, সেইমাত্র আমার জনৈক বন্ধুকে ফোন করলাম, মোবাইলের এক প্রান্তে বললাম, পদ্মাসেতুর উদ্বোধন ২৫ জুন। এই কথা বলা মাত্রই তার কণ্ঠে অযুত স্বপ্নের লক্ষ্যপূরণ নির্দেশ করেছে তা আমার বুঝতে বাকি রইল না পদ্মাসেতু দক্ষিণবঙ্গের মানুষের জন্য শুধু না পুরো বাংলাদেশের জন্য একটি অবিস্মরণীয় অর্জন। বাংলাদেশের দক্ষিণ বঙ্গের আয়তন মোট আয়তনের ২৯ শতাংশ। পদ্মা সেতুর মাধ্যমে দক্ষিণ অংশের সাথে যোগাযোগ স্থাপনের মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক সকল ক্ষেত্রে অভাবনীয় পরিবর্তন সূচিত হবে।
শিল্পক্ষেত্রে পদ্মাসেতুর গুরুত্ব বলতে গেলে এর মাধ্যমে সৃষ্টি হবে নতুন নতুন খাত তাছাড়া সেতুকে কেন্দ্র করে গতিশীল হবে পায়রা সমুদ্রবন্দর এবং দক্ষিণ বঙ্গের ২১ টি জেলা সংযুক্ত হবে ট্রান্স এশিয়া হাইওয়ের সাথে যার মাধ্যমে নতুন নতুন এলাকা গড়ে উঠবে। শিল্পকারখানা ও দক্ষিণ বঙ্গে সুন্দরবন অবস্থিত হওয়ার কারণে ও কাঁচামাল সহজলভ্যতার কারণে কৃষিভিত্তিক অনেক শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠবে ও সৃষ্টি হবে কর্মসংস্থান। তাছাড়া দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের সাথে উত্তর পূর্বাঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো না হওয়ার কারণে সৃষ্ট উৎপাদিত পণ্যের বিনিময় ও মূল্য নির্ধারনে অনেক সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে, পদ্মাসেতুর ফলে কৃষিতে প্রযুক্তির ছোয়া উৎপাদিত দ্রব্যের বিনিময় ও ন্যায্য মূল্যে দ্রব্য বিক্রির মাধ্যমে কৃষকদের মুখে হাসি ফুটবে।
পদ্মাসেতুর ফলে দক্ষিণ বঙ্গের ২১ টি জেলার সাথে সহজ যোগাযোগ ব্যবস্থা সৃষ্টি হবে দক্ষিণ বঙ্গে থাকা বিভিন্ন পর্যটন স্থান যেমন: কুয়াকাটা সমুদ্রবন্দর, ষাট গম্বুজ মসজিদ, খান জাহান আলীর মাজার, সুন্দরবন ইত্যাদি পর্যটন জায়গাগুলোতে টুরিস্টরা যেতে পারবে সহজে এবং দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি প্রচুর কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে। বিশ্বব্যাংকের মতে পদ্মাসেতুর ফলে বাংলাদেশে ৩০ মিলিয়ন মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যোগাযোগ, যাতায়াত, কৃষিশিল্প ও কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে লাভবান হবে এবং পদ্মাসেতু দেশের উন্নয়নে এবং দেশের জিডিপি এর ক্ষেত্রে ২% ভূমিকা রাখবে। পদ্মাসেতুর ফলে পণ্যের নতুন নতুন বাজার সৃষ্টি হবে যা দেশের উন্নয়নে এক অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে।
পদ্মাসেতুর ফলে দক্ষিণ বঙ্গে উৎপাদন ৭৩.৪ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পাবে। তাছাড়া পদ্মাসেতুর মাধ্যমে দক্ষিণ বঙ্গের সাথে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের সাথে সাথে বিভিন্ন ঐতিহ্য, সাহিত্যপ্রথা ইত্যাদির বিনিময় হবে যা দেশের শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতির উন্নয়নে অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে। মানব সম্পদের উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন কর্মমুখি শিক্ষা, সঠিক ব্যবস্থাপনা তথ্যের প্রভাব ও কারিগরি শিক্ষার প্রসার যা আরো অভূতপূর্ণভাবে বৃদ্ধি পাবে পদ্মা সেতুর কারণে। সুতরাং পদ্মাসেতু দেশের মানব সম্পদ উন্নয়নে এক অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে। যেহেতু পদ্মাসেতু ১০০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এবং পদ্মা নদীর পানি প্রবাহ মিলিত হয়েছে যমুনা ও মেঘনার সমন্বয়ে সেহেতু এটি পানি প্রবাহের ক্ষেত্রে একটি গুণগত ব্যবস্থার সৃষ্টি করবে এবং পরিবেশের জন্য আশীর্বাদ বয়ে আনবে পদ্মাসেতুর ফলে দক্ষিণ বঙ্গের মানুষেরা অতি সহজে গ্যাস, বিদ্যৎ টেলিযোগাযোগের ব্যবস্থা হবে যা দক্ষিণবঙ্গের শিল্প ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে। পদ্মাসেতু দক্ষিণবঙ্গের মানুষের জন্য একটি আশীর্বাদ যা তাদের সার্বিক উন্নয়নে অগ্রণী ভূমিকা রাখবে।
লেখক,
প্রভাষক, সমাজকর্ম বিভাগ
বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: