একজন নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব ও রাজনৈতিক দূরদৃষ্টিকে মূল্যায়ন করে ব্রিটিশ লর্ড ফেন্যার ব্রোকওয়ে বলেছিলেন, ‘‘শেখ মুজিব জর্জ ওয়াশিংটন, গান্ধী এবং দ্য ভ্যালেরার থেকেও মহান নেতা ছিলেন।’'
বঙ্গবন্ধু তাঁর ব্যক্তিগত নোটবুকে লিখেছিলেন, “একজন মানুষ হিসেবে সমগ্র মানবজাতি নিয়েই আমি ভাবি। একজন বাঙালি হিসেবে যা কিছু বাঙালিদের সাথে সম্পর্কিত তাই আমাকে গভীরভাবে ভাবায়। এই নিরন্তর সম্পৃক্তির উৎস ভালোবাসা, অক্ষয় ভালোবাসা, যে ভালোবাসা আমার রাজনীতি ও অস্তিত্বকে অর্থবহ করে তোলে।”
আজ থেকে ঠিক ১০২ বছর পূর্বে আজকের এইদিনে ১৯২০ খ্রিস্টাব্দের ১৭ মার্চ; ১৩২৬ বঙ্গাব্দের ৩ চৈত্র তারিখের এক আলোকিত প্রভাতে চিরকাল শোষিত বাঙালি জাতির মুক্তির বারতা নিয়ে বাংলা মায়ের কোলে জন্ম নিয়েছেন কালজয়ী ইতিহাসের মহানায়ক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। শেখ মুজিবকে মা বাবা আদর করে খোকা নামেই ডাকতেন।
শৈশব থেকেই শেখ মুজিব তাঁর পারিপার্শ্বিক সমাজের প্রতি গভীর আত্মীয়তা ও দায়বদ্ধতা অনুভব করতেন। চিরবিপ্লবী মুজিব ছিলেন অন্যায়ের প্রতি আপোষহিন এক অনন্য মানবসত্তা। সেজন্য তাকে ছোট্ট বয়সেই কারাবরণ করতে হয়েছে। সেই ১৯৩৮ সালের দিকে কিশোর বঙ্গবন্ধু যখন গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলে পড়েন। তৎকালীন অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক এবং শ্রমমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী গোপালগঞ্জ আসেন। মুজিব তাদেরকে হোস্টেলের ছাদের বেহালদশা সম্পর্কে অবহিত করে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য অনুরোধ জানান।
জাতীয় নেতাদের কাছে কিশোর মুজিবের এই অনুরোধের মধ্যে নিহীত ছিলো নিজ সমাজ ও দেশের প্রতি গভীর দায়বদ্ধতা এবং ভালোবাসার সুপ্ত বীজ। যা পরবর্তিকালে তাঁকে বাঙালি জাতির ত্রাণকর্তারূপি মহিরুহে পরিণত করেছিলো।
১৯৪৭ সালের দেশভাগ তথা পাকিস্তান সৃষ্টির নেপথ্যে ভারতীয় উপমহাদেশের কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে পাকিস্তান আন্দোলনে অন্যতম প্রধান ছাত্রনেতা ছিলেন ইসলামিয়া কলেজ ছাত্র সংসদের নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক(জিএস) বেকার হোস্টেলের মুজিবুর রহমান। কিন্তু দেশভাগের পর বঙ্গবন্ধু অনুধাবন করলেন পাকিস্তান অর্জিত হলেও সাংস্কৃতিকভাবে একটি স্বতন্ত্র জাতি হিসেবে বাঙালি জাতির কোন রাজনৈতিক ও আর্থ সামাজিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়নি। কেননা পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ততদিনে বাঙালির মুখের ভাষা বাংলাকেও হরণ করতে আগ্রাসী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়।
বাঙালি জাতির সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির মহান স্বপ্নকে লালন করে ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি, বঙ্গবন্ধু পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ(বর্তমান নাম বাংলাদেশ ছাত্রলীগ) প্রতীষ্ঠা করেন । ১৯৪৮ সালে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার রাজপথের আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে গিয়ে ১১ মার্চ গ্রেফতার হন শেখু মুজিবুর রহমান,শামসুল আলম প্রমুখসহ সহ ৬৯ জন বাংলা মায়ের দামাল ছেলে। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ছিলো রক্তস্নাত বাংলা ভাষার চূড়ান্ত রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠার দিন। সেদিন রাজপথ রঞ্জিত হয়েছিলো বাংলা মায়ের দামাল ছেলের বুকের তাজা রক্তে। বাংলা ভাষার রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি অর্জনের মধ্যেই বাঙালি জাতির স্বাধীনতার চিরকালীন আকাঙ্ক্ষার মনস্তাত্ত্বিক ও রাজনৈতিক সম্ভাবনা জাগ্রত হয়েছিলো।
পরবর্তীকালে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রত্যক্ষ করে বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতিকে রাজনৈতিকভাবে ঐক্যবদ্ধ করতে আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে মুসলিম শব্দটি বাদ দিয়ে শুধুমাত্র আওয়ামীলীগ লীগ করার মধ্য দিয়ে এক যুগান্তকারী রাজনৈতিক পদক্ষেপ গ্রহণ করলেন। বঙ্গবন্ধুর এই পদক্ষেপের মাঝেই প্রোথিত হয়েছিলো বাঙালি জাতিসত্তার অভিন্ন সমাবেশ যেখানে বাংলার হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খৃষ্টান নির্বিশেষে মানুষ হিসেবে সকলের সমান মর্যাদা ও সমান রাজনৈতিক অধিকার নিশ্চিতভাবে প্রতিষ্ঠিত হবে। ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে
এরপর ১৯৫৭ সালে করাচীতে পাকিস্তানের গণপরিষদের তরুণ সদস্য শেখ মুজিবুর রহমান বক্তৃতা দেয়ার সময় "পূর্ব পাকিস্তান" নামটির প্রতিবাদ করে বলেন যে, পূর্ব বাংলা নামের একটি ইতিহাস ও ঐতিহ্য আছে।
"আর যদি পূর্ব পাকিস্তান নাম রাখতেই হয়, তাহলে বাংলার মানুষের জনমত যাচাই করতে হবে। তারা নামের এই পরিবর্তন মেনে নিবে কিনা -সেজন্য গণভোট নিতে হবে।"
১৯৬২ এর শিক্ষা আন্দোলন, বিশেষ করে বঙ্গবন্ধু প্রণীত ১৯৬৬ সালের ৬ দফা ছিলো পরাধীন জাতি হিসেবে বাঙালির মুক্তির মহান ম্যাগনাকার্টা। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ৬ দফা আন্দোলনের ধারবাহিক কর্মসূচীর সফল রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া হিসেবে ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে স্বৈরাচার আয়ুবশাহীর পতন ঘটে। সেসময় গণঅভ্যুত্থানে সাধারণ রাজনৈতিক নেতাকর্মী ও ছাত্র-জনতার স্লোগানের ভাষা ছিলো,
‘‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো,
বাংলাদেশ স্বাধীন করো।’’
আবহমান বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাসের কালপ্রবাহে এই প্রথম পূর্ব বাংলাকে "বাংলাদেশ" নামে অভিহিত করা হয়।
একই বছরের ৫ ডিসেম্বর গণতন্ত্রের মানসপুত্র হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দির ৬ষ্ঠ মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত আলোচনা সভায় শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষণা করেন, "আমাদের স্বাধীন দেশটির নাম হবে বাংলাদেশ"।
ওই বৈঠকে আওয়ামী লীগের নেতারা বিভিন্ন নাম প্রস্তাব করেন। পরে শেখ মুজিবুর রহমান "বাংলাদেশ" নামটি প্রস্তাব করলে তাতে সবাই একবাক্যে সায় দেন।
এই নাম দেয়ার কারণ হিসেবে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘১৯৫২ সালে সংগ্রামের মাধ্যমে অর্জিত বাংলা ভাষা থেকে "বাংলা", এরপর স্বাধীন দেশের আন্দোলন সংগ্রাম থেকে দেশ। এই দুটো ইতিহাস ও সংগ্রামকে এক করে "বাংলাদেশ" নামকরণ করা হয়।’
এই ঐতিহাসিক ঘটনার পর সরকারি নথিপত্রে পূর্ব পাকিস্তান লিখতে হলেও মুখে কেউ পূর্ব পাকিস্তান নাম উচ্চারণ করতেন না। সবাই বলতেন বাংলাদেশ। বাংলাদেশের নামকরণে মুখ্য ভূমিকা পালনের মাধ্যমে বিশ্বের রাজনৈতিক ইতিহাসে বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ পরস্পরের অবিচ্ছেদ্য পরিপূরক হয়ে ওঠে।
১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে সমগ্র পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠ সংসদীয় আসনে বিজয়ী হয় বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকের প্রার্থীগণ। ১৯৭০ এর নির্বাচনে বিপুল জনসমর্থন পেয়ে বঙ্গবন্ধু হয়ে উঠলেন স্বাধীকার আদায়ের পথে বাঙালির এগিয়ে যাওয়ার অবিসংবাদিত নেতা, সমস্ত আন্দোলন সংগ্রামের প্রধান মুখপাত্র। কিন্তু নির্বাচনে জয়লাভ করা সত্ত্বেও পাকিস্তানি শোষকচক্র বাঙালিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে নানা ছলচাতুরী প্রবঞ্চণার আশ্রয় নেয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনায় ১৯৭১ সালের ২ মার্চ ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন নেতৃবৃন্দ কর্তৃক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে ছাত্র সমাবেশ অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলার মানচিত্রখচিত পতাকা উত্তোলন করা হয়। পরদিন ৩ মার্চ বঙ্গবন্ধু তাঁর ধানমন্ডির বাসভবনে নিজহাতে স্বাধীন বাংলার মানচিত্রখচিত পতাকা উত্তোলন করেন।
এ ঘটনার মধ্য দিয়ে কার্যত পূর্বপাকিস্তান নামের অঞ্চলটিতে বসবাসকারী জনগণের মনোজগতে পাকিস্তান রাষ্ট্রের অপুমৃত্যু ঘটে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের সমূহ সম্ভাবনার সুবাতাস বয়ে চলে নদীবিধৌত সবুজ শ্যামল বাংলার ঘরে ঘরে।
দেখতে দেখতে কয়েকদিনের ব্যবধানে ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ চলে আসে ইতিহাসের সেই মাহেন্দ্রক্ষণ যেদিন বঙ্গবন্ধুর মুখনিসৃত ‘জয় বাংলা’ ওঙ্কার ধ্বনিত হয় রেসকোর্স ময়দানে। এই মহান বীজমন্ত্র, চিরশোষণের অন্ধকার দেয়াল ভেদ করে উচ্চারিত, পরম আরাধ্য ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি উচ্চারণের সাথে সাথে-ই বিশ্বমানচিত্রে এক স্বাধীন স্বতন্ত্র জাতিসত্তার রাজনৈতিক সুর্যোদয় সাধিত হয়।
প্রদত্ত ১৯ মিনিটের বাঙালি জাতির ২৩ বছরের শোষণ বঞ্চণার করুন ইতিহাসের দৃশ্যপট সৃষ্টি করলেন অনবদ্য কাব্যিক ভাব ও ভাষিক ব্যঞ্জনায়। মুক্তি সংগ্রামের উল্লাসে উজ্জীবিত হলো কোটি জনতা। ভাষণে ঠিক এভাবেই তিনি নিরস্ত্র বাঙালিকে কেমন করে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে হবে তা সম্পূর্ণরূপে বাতলে দিয়েছিলেন কালজয়ী ইতিহাস নির্মাণের মহান প্রমিথিউস, বাংলা মায়ের প্রথম ভূমিপুত্র বঙ্গবন্ধু ,
“তোমাদের ওপর আমার অনুরোধ রইল, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো, তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সবকিছু আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি, তোমরা বন্ধ করে দেবে।”
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চ বাঙালি জাতির মুক্তির বার্তাবাহী কালজয়ী ভাষণে,
‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম,
এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম(৩)’’
পঙক্তি উচ্চারণের সাথে সাথে খসে পড়েছিলো বাঙালির হাজার বছরের দাসত্ব শৃঙ্খল, ঘুচে গেলো বঞ্চনা গ্লানির করুণ বেদনার্ত ইতিহাস। ভাষণের সমাপ্তিতে 'জয় বাংলা' ওঙ্কার ধ্বনিতে বঙ্গবন্ধু বাঙালির স্বতন্ত্র রাজনৈতিক জাতিসত্তার শুভ উদ্বোধন করলেন।
বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণকে মূল্যায়ন করতে গিয়ে প্রখ্যাত চিন্তাবিদ আহমদ ছফা উল্লেখ করেন,
‘‘বস্তুত: বাঙালি জাতির সর্বশ্রেষ্ঠ কাব্য গীতাঞ্জলি নয়,বলাকা নয়,সোনারতরী নয়, ‘আর দাবায়ে রাখতে পারবানা’। সহস্রাধিক বছরের পরাধীন জীবনের অস্তিত্বের প্রতি সরাসরি অস্বীকৃতি জানিয়ে এই উচ্চারণের মাধ্যমে গোটা জাতির চিত্তলোকে তিনি এমন একটা অনমনীয় আকাঙ্ক্ষার সৃষ্টি করেছিলেন যা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিরাট এক প্রেরণা হিসাবে কাজ করেছে। এই গৌরব শেখ মুজিবুর রহমানকে অবশ্যই দিতে হবে।”(১)
বাঙালিকে পাকিস্তানি শোষণের নাগপাশ থেকে মুক্ত করতে বার বার কারাবরণ করেন বঙ্গবন্ধু। শোষক শ্রেণির নির্যাতনের শিকার হয়্ব যৌবনের অধিকাংশ সময়ই তাঁকে রাজবন্দি হয়ে কারাগারে কাটাতে হয়েছে। তবুও তিনি জাতির বৃহত্তর কল্যাণে জাতির সামগ্রিক মুক্তির লক্ষ্যে অবিচল থেকে বাঙালি জাতির অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন সংগ্রামের চিরন্তন সংশপ্তক হয়ে লড়াই অব্যাহত রেখেছিলেন তাঁর মহানজীবনকালের শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত। তাই মৃত্যুর পরেও তিনি আরোও শক্তিমান অনুপ্রেরণা হয়ে বেঁচে আছেন পৃথিবীর শোষিত মানুষের মুক্তি সংগ্রামের অনুপ্রেরণা হয়ে।
জাতির উদ্দেশ্যে ৭ মার্চের ভাষণে যুদ্ধের দিক নির্দেশনা প্রদান করার পর সার্বিক দিক বিবেচনায় ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে অয়ারলেসের মাধ্যমে স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ঘোষণা প্রদান করেন। এ ঘোষণার মধ্য দিয়ে বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু বিশ্বের বুকে প্রতিষ্ঠা করলেন একটি জাতির আত্মপরিচয়, একটি স্বাধীন রাষ্ট্র, একটি মানচিত্র, একটি দীপ্ত পতাকা। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বেই মূলত ১৯৭১ সালে ৯ মাসের লাখো শহীদ বীরাঙ্গনার আত্মত্যাগ ও রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ১৬ ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হয়।
শোষিত, নিপীড়িত, নিষ্পেষিত, বঞ্চিত ও অসহায় মানুষের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে জীবন উৎসর্গ করে গিয়েছেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বিশ্ব আজ যুদ্ধ বিগ্রহ, খাদ্যাভাব পরিবেশ বিপর্যয়সহ নানা অস্থিরতায় জর্জরিত , যা বঙ্গবন্ধু অনেক আগেই উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। তাই তিনি বিশ্বাস করতেন, মাটি থাকলে ফসল হবে আর ফসল হলে খাদ্যাভাব থাকবে না।
বঙ্গবন্ধুর বিশ্বাস ছিলো যে , “যে দেশের মাটিতে একটি বীজ লাগালে একটি গাছ হয় সে দেশের মানুষ না খেয়ে মরতে পারে না।” বঙ্গবন্ধুর জীবনদর্শন বিশ্বদরবারে চিরকাল সমাদৃত।
ফ্যাসিবাদ, সাম্রাজ্যবাদকে পরাভূত করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের মাধ্যমে উদার অর্থনীতি ও বন্ধুত্বের ভিত্তিতে রাষ্ট্র পরিচালনা করে বিশ্বে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। বিশ্বমানবতার অন্যতম মুখপাত্র বঙ্গবন্ধুর বন্ধুত্বপূর্ণ বৈদেশিক নীতিতেও ছিল বিশ্বমানবতার প্রতি তার দূরদৃষ্টির প্রতিফলন।
বঙ্গবন্ধু অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির স্বরূপ খুঁজে পাওয়া যায় তার নিজস্ব মূল্যায়নে। তাঁর মতে, “পৃথিবীর বৃহত্তর শক্তি যে অর্থ ব্যয় করে মানুষকে মারার অস্ত্র তৈরি করছে, সেই অর্থ গরিবদের সাহায্য দিলে পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠা হতে পারে।”
বঙ্গবন্ধুর মূল্যায়নটি আজও চিরসত্য। বিশ্ব শান্তির স্বপক্ষে অবদান ও বাঙালি জাতির মুক্তি আন্দোলনের স্বীকৃতিস্বরূপ বঙ্গবন্ধুকে ১৯৭২ সালের ১০ অক্টোবর বিশ্ব শান্তি পরিষদের প্রেসিডিয়াম কমিটি বিশ্ব শান্তি পরিষদের মহাসচিব রমেশ চন্দ্রের নিকট জুলিও কুরি পদক প্রদানের প্রস্তাব করেন।
১৯৭৩ সালের ২২ থেকে ২৩ মে বিশ্ব শান্তি পরিষদ আয়োজিত ঢাকায় এশিয়ান পিস এন্ড সিকিউরিটি কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হয়। সেই কনফারেন্সের ২য় দিনে অর্থাৎ ২৩ মে ১৯৭৩ বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের উত্তর প্লাজায় উন্মুক্ত চত্ত্বরে সুসজ্জিত প্যান্ডেলে বিশ্বশান্তি পরিষদের মহাসচিব রমেশ চন্দ্র বঙ্গবন্ধুকে “জুলিও কুরি” পদক প্রদান করেন। পদক প্রদানকালে তিনি বলেন, “শেখ মুজিব শুধু বঙ্গবন্ধু নন, আজ থেকে তিনি বিশ্ববন্ধুও বটে।’’
১৯৭৫ সালের ভয়াল ১৫ আগস্ট,পাকিস্তান-মার্কিন যৌথষড়যন্ত্রে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যাকারী কতিপয় কুশিলব ও দুর্বৃত্তকে উদ্দেশ্য করে শহীদ কাদরী লিখেন বেদনা বিদগ্ধ কাব্য,
‘‘বাঘ কিংবা ভালুকের মতো নয়,
বঙ্গোপসাগর থেকে উঠে আসা হাঙরের দল নয়
না, কোনো উপমায় তাদের গ্রেপ্তার করা যাবে না
তাদের পরনে ছিল ইউনিফর্ম
বুট, সৈনিকের টুপি,
বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাদের কথাও হয়েছিলো,
তারা ব্যবহার করেছিল
এক্কেবারে খাঁটি বাঙালির মতো
বাংলা ভাষা। অস্বীকার করার উপায় নেই ওরা মানুষের মতো
দেখতে, এবং ওরা মানুষই
ওরা বাংলা মানুষ
এর চেয়ে ভয়াবহ কোনো কথা আমি আর শুনবো না কোনোদিন।’’(২)
বঙ্গবন্ধু বিবিসির জরিপে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি হিসেবে স্বীকৃত এবং জাতিসংঘ কর্তৃক Friends of the World বা বিশ্ববন্ধু হিসেবে স্বীকৃত।
বঙ্গবন্ধুর পিতা শেখ লুৎফর রহমান জীবদ্দশায় গণমাধ্যমে প্রদত্ত এক সাক্ষাৎকারে বলেন,
‘‘একজন বাঙালি হিসেবে বঙ্গবন্ধু আমার-ও পিতা।’’
বাঙালি জাতির মুক্তির মহানায়ক, এ জাতির বিজয়ী ইতিহাসের নির্মাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর ১০২ তম জন্মদিনে তাঁকে স্মরণ করছি শামসুর রাহমানের বিদগ্ধ কবিতার পঙক্তির অবিনাশী আলপনায় ;
‘‘ধন্য সেই পুরুষ নদীর সাঁতার পানি থেকে যে উঠে আসে
সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে;
ধন্য সেই পুরুষ, নীল পাহাড়ের চূড়া থেকে যে নেমে আসে
প্রজাপতিময় সবুজ গালিচার মত উপত্যকায়;
ধন্য সেই পুরুষ হৈমন্তিক বিল থেকে যে উঠে আসে
রঙ বেরঙের পাখি ওড়াতে ওড়াতে।
ধন্য সেই পুরুষ কাহাতের পর মই-দেয়া ক্ষেত থেকে যে ছুটে আসে
ফসলের স্বপ্ন দেখতে দেখতে।
ধন্য আমরা, দেখতে পাই দূরদিগন্ত থেকে এখনো তুমি আসো,
আর তোমারই প্রতীক্ষায়
ব্যাকুল আমাদের প্রাণ, যেন গ্রীষ্মকাতর হরিণ
জলধারার জন্যে।
তোমার বুক ফুঁড়ে অহংকারের মতো
ফুটে আছে রক্তজবা,
আর আমরা সেই পুষ্পের দিকে চেয়ে থাকি, আমাদের চোখের পলক পড়তে চায় না,
অপরাধে নত হয়ে আসে আমাদের দুঃস্বপ্নময় মাথা।
দেখ, একে একে সকলেই যাচ্ছে বিপথে অধঃপাত মোহিনী নর্তকীর মতো
জুড়ে দিয়েছে বিবেক-ভোলানো নাচ মনীষার মিনারে,
বিশ্বস্ততা চোরা গর্ত খুঁড়ছে সুহৃদের জন্যে
সত্য খান খান হয়ে যাচ্ছে যখন তখন
কুমোরের ভাঙ্গা পাত্রের মতো,
চাটুকারদের ঠোঁটে অষ্টপ্রহর ছোটে কথার তুবড়ি,
দেখ, যে কোন ফসলের গাছ
সময়ে-অসময়ে ভরে উঠেছে শুধু মাকাল ফলে।
ঝলসে-যাওয়া ঘাসের মত শুকিয়ে যাচ্ছে মমতা
দেখ, এখানে আজ
কাক আর কোকিলের মধ্যে কোনো ভেদ নেই।
নানা ছলছুতোয়
ধন্য সেই পুরুষ, যাঁর নামের ওপর রৌদ্র ঝরে চিরকাল,
গান হয়ে
নেমে আসে শ্রাবণের বৃষ্টিধারা, যাঁর নামের ওপর
কখনো ধুলো জমতে দেয় না হাওয়া,
ধন্য সেই পুরুষ যাঁর নামের উপর পাখা মেলে দেয় জ্যোৎস্নার সারস,
ধন্য সেই পুরুষ যাঁর নামের উপর পতাকার মতো
দুলতে থাকে স্বাধীনতা,
ধন্য সেই পুরুষ যাঁর নামের ওপর ঝরে
মুক্তিযোদ্ধাদের জয়ধ্বনি।
স্বৈরাচারের মাথায় মুকুট পরাচ্ছে ফেরেব্বাজের দল।
দেখ, প্রত্যেকটি মানুষের মাথা
তোমার হাঁটুর চেয়ে এক তিল উঁচুতে উঠতে পারছে না কিছুতেই।
তোমাকে হারিয়ে আমরা সন্ধ্যায়,
হারিয়ে যাওয়া ছায়ারই মতো হয়ে যাচ্ছিলাম,
আমাদের দিনগুলি ঢেকে যাচ্ছিল শোকের পোশাকে,
তোমার বিচ্ছেদের সংকটের দিনে
আমরা নিজেদের ধ্বংসস্তূপে বসে বিলাপে ক্রন্দনে
আকাশকে ব্যথিত করে তুললাম ক্রমাগত; তুমি সেই বিলাপকে
রূপান্তরিত করেছো জীবনের স্তুতিগানে, কেননা জেনেছি –
জীবিতের চেয়েও অধিক জীবিত তুমি।’’(৩)
রেফারেন্সসমূহ:
(১)শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্য প্রবন্ধ, আহমদ ছফা ( পৃষ্ঠা ২১)
(২) হন্তারকদের প্রতি , শহীদ কাদরী
(৩) ধন্য সেই পুরুষ , শামসুর রাহমান।
লেখক: ইয়াসির আরাফাত তূর্য,
সাংগঠনিক সম্পাদক,
বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: