মাহামুদুল হক
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। কিন্তু ৮ জানুয়ারি ১৯৭২ পর্যন্ত পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হতে পারেননি বঙ্গবন্ধু। ২৫ মার্চ ১৯৭১ রাতে স্বাধীনতা ঘোষণার পরপরই বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানের কারাগারে আটক করে নিয়ে যাওয়া হয়। কারাগারে সামরিক আদালতের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুকে প্রহসনমূলক বিচারে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। সেলের পাশে কবর খোঁড়াও হয়েছিল। অভিযোগ ছিল পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনার। এই যুদ্ধই আমাদের লাল-সবুজের পতাকা উপহার দিয়েছে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পরাজয়ের কয়েকদিন পর প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে উৎখাত করে ক্ষমতা গ্রহণকারী জুলফিকার আলী ভুট্টো বিশ্ব সম্প্রদায়ের প্রবল চাপের মুখে বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দেওয়ার ঘোষণা দেন। ভুট্টো চেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুকে প্রথমে তেহরানে পাঠানো হোক। কিন্তু বঙ্গবন্ধু ভুট্টোর তেহরানে যাওয়ার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। লন্ডনকে বিকল্প হিসেবে উপস্থাপন করা হলে বঙ্গবন্ধু তা গ্রহণ করেন। ২৯০ দিন পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগারে নির্জনে বন্দি রাখার পর ৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুকে মুক্ত করা হয়।
অবিসংবাদিত নেতা ও মুক্তিযুদ্ধের সর্বোচ্চ কমান্ডার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বহনকারী পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারওয়েজের একটি ফ্লাইট লন্ডনের হিথ্রো বিমানবন্দরে অবতরণ করে ওইদিন। তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়াার্ড হিথ ১০ ডাউনিং স্ট্রিটে বঙ্গবন্ধুকে স্বাগত জানান। তিনি বঙ্গবন্ধুকে সফরকারী রাষ্ট্রপ্রধানের সম্মান প্রদান করেন। এটাই রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে বঙ্গবন্ধুর প্রথম সম্মামনা।
১০ জানুয়ারি ব্রিটিশ রয়্যাল এয়ার ফোর্সের বিমান বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে দিল্লি হয়ে ঢাকায় অবতরণ করে। দিল্লিতে ইন্দিরা গান্ধী বঙ্গবন্ধুকে স্বাগত জানান। দিল্লি বিমানবন্দরে আনুষ্ঠানিক ভাষণে বঙ্গবন্ধু ভারত সরকার ও ওই দেশের জনগণকে ধন্যবাদ জানান স্বাধীনতার যাত্রাকে সম্ভব করার জন্য, আত্মত্যাগের জন্য। তবে ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে সাক্ষাতের সময় তিনি ভারতীয় সৈন্য বাংলাদেশের মাটি থেকে তিন মাসের মধ্যে সরিয়ে নেওয়ার অনুরোধ জানাতে ভুলেননি।
তিনি দিল্লি বিমানবন্দরে বলেন, ‘এ যাত্রা অন্ধকার থেকে আলোর যাত্রা, বন্দিদশা থেকে মুক্তির, ধ্বংসস্তুপ থেকে আশা। আমি অন্তত নয় মাস পর আমার স্বপ্নের দেশ সোনার বাংলায় ফিরে যাচ্ছি। এই নয় মাস আমার জনগণের নিকট তা শত বছর। যখন আমাকে আমার জনগণের কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া হয়েছিল তখন তারা কেঁদেছিল। যখন আমি বন্দি ছিলাম তখন তারা যুদ্ধরত এবং তাদের কাছে যখন ফিরে যাচ্ছি তারা তখন বিজয়ী।’
বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে পা রাখেন তখন সমগ্র ঢাকা শহর প্রিয় নেতাকে দেখার জন্য অপেক্ষা করছিলো সাত কোটি মানুষ। এমনকি, বঙ্গবন্ধুকে বহনকারী বিমান অবতরণ করার সুযোগ পাচ্ছিল না ঢাকা জনসমুদ্রে পরিণত হওয়ার কারণে। পাকিস্তানে বঙ্গবন্ধু একজন বন্দি হিসেবে ছিলেন। অবশেষে দেশের মাটিতে পা রাখলেন অদম্য সাহস ও আনন্দ নিয়ে বিজয়ের মহান নেতা হিসেবে। তার নেতৃত্ব দেশের স্বাধীনতার জন্য অনিবার্য ছিলো।
বঙ্গবন্ধু বিমানবন্দর থেকে রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) যান। এখানে তিনি আরেকটি ঐতিহাসিক ভাষণ দেন। মুক্তিযুদ্ধের শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বঙ্গবন্ধু তার ভাষণে বলেন, ‘এখন আমার বাংলাদেশ স্বাধীন, আমার জীবনের চাওয়া পূর্ণ হয়েছে, আমার বাংলার মানুষ স্বাধীন হয়েছে। আমার বাংলা স্বাধীন থাকবে।’
তিনি বলেন, ‘আজ থেকে আমার অনুরোধ, আজ থেকে আমার আদেশ, আজ থেকে আমার হুকুম ভাই হিসেবে, নেতা হিসেবে নয়, প্রেসিডেন্ট হিসেবে নয়, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে। আমি তোমাদের ভাই, তোমরা আমার ভাই। এ স্বাধীনতা আমার ব্যর্থ হয়ে যাবে যদি আমার বাংলার মানুষ পেট ভরে ভাত না খায়। এ স্বাধীনতা পূর্ণ হবে না যদি বাংলার মা-বোনেরা কাপড় না পায়। এ স্বাধীনতা আমার পূর্ণ হবে না যদি এদেশের যুবকরা চাকরি না পায়।’
তিনি যুদ্ধবিধ্বস্ত স্বাধীন দেশে পুনর্গঠনের পরিকল্পনাও ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, ‘ভাইয়েরা আমার, যথেষ্ট কাজ পড়ে রয়েছে আপনারা জানেন। আমি চাই যেখানে রাস্তা ভেঙে গিয়েছে জনগণ নিজেরাই রাস্তা করতে শুরু করে দাও। আমি চাই, যাও জমিতে ধান বুনো। কর্মচারীদের বলতে চাই, একজনও ঘুষ খাবেন না। আমি দোষ ক্ষমা করব না।’
বঙ্গবন্ধু দেশ পরিচালনার পদ্ধতি উল্লেখ করে বলেন, ‘আমার রাষ্ট্র, এই বাংলাদেশে হবে সমাজতন্ত্র ব্যবস্থা। এই বাংলাদেশে হবে গণতন্ত্র। এই বাংলাদেশে হবে ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র।’
একই স্থানে বঙ্গবন্ধু ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ভাষণে দিয়েছিলেন যুদ্ধ পরিচালনার দিক নির্দেশনা। আর ১৯৭১ সালের ১০ জানুয়ারির ভাষণে দিলে স্বাধীন রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশনা। যদিও বঙ্গবন্ধু বলেন, তিনি কোনো ভাষণ দেবেন না। তার হতে কোনো লিখিত ভাষণও ছিল না। তবে বঙ্গবন্ধুর ওইদিনের কথা ছিল মুক্তির আরেক সোপান। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীন বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তনের মধ্য দিয়ে সাত কোটি মানুষের মুক্তির আকাঙ্ক্ষা পূরণ হয়। সদ্য-স্বাধীন মাটিতে প্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধুকে পেয়ে বাঙালি পায় স্বাধীনতার আরেক স্বাদ।
লেখক
শিক্ষক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর
এবং
সহ-তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক, বঙ্গবন্ধু পরিষদ কেন্দ্রিয় কমিটি
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: