গতকাল বুধবার থেকে শুরু রয়েছে রোজার মাস। রোজার ফজিলতের বিষয়ে কোরআন-হাদিসে অনেক ব্যাখ্যা রয়েছে। শারীরিক উপকারিতা বিষয়ে ব্যাখ্যা চিকিৎসা বিজ্ঞানের বিভিন্ন গবেষণায়ও উঠে এসেছে। রমজানের রোজায় আল্লাহর সন্তুষ্টির সাথে সাথে বৈজ্ঞানিকভাবে আমরা নানান শারীরিক উপকারিতা পেয়ে থাকি।
প্রতিবছর কোটি কোটি মুসলমান এক মাস রোজা রাখেন সূর্যোদোয় হতে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহারে বিরত থেকেন। এর ফলে শরীরে কিছু পরিবর্তন আসে। বিবিসি বাংলার এক প্রতিবেদনে এ পরিবর্তনগুলো তুলে ধরা হয়েছে।
প্রথম কয়েকদিন: সবচেয়ে কষ্টকর
শেষবার খাবার খাওয়ার পর আট ঘণ্টা পার না হওয়া পর্যন্ত কিন্তু মানুষের শরীরে সেই অর্থে উপোস বা রোজার প্রভাব পড়ে না। আমরা যে খাবার খাই, পাকস্থলীতে তা পুরোপুরি হজম হতে এবং এর পুষ্টি শোষণ করতে অন্তত আট ঘন্টা সময় নেয় শরীর।
যখন এই খাদ্য পুরোপুরি হজম হয়ে যায়, তখন আমাদের শরীর যকৃৎ এবং মাংসপেশীতে সঞ্চিত থাকে যে গ্লুকোজ, সেটা থেকে শক্তি নেওয়ার চেষ্টা করে। শরীর যখন এই চর্বি খরচ করতে শুরু করে, তা আমাদের ওজন কমাতে সাহায্য করে। এটি কোলেস্টেরলের মাত্রা কমায় এবং ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমায়।
তবে যেহেতু রক্তে সুগার বা শর্করার মাত্রা কমে যায়, সে কারণে হয়তো কিছুটা দুর্বল এবং ঝিমুনির ভাব আসতে পারে। এ ছাড়া কারো কারো ক্ষেত্রে মাথাব্যথা, মাথা ঘোরা, বমি বমি ভাব বা নিশ্বাসে দুর্গন্ধ হতে পারে। এ সময়টাতেই আসলে শরীরে সবচেয়ে বেশি ক্ষুধা লাগে।
৩ হতে ৭ রোজা: পানিশূন্যতা থেকে সাবধান
প্রথম কয়েকদিনের পর আপনার শরীর যখন রোজায় অভ্যস্ত হয়ে উঠছে, তখন শরীরে চর্বি গলে গিয়ে তা রক্তের শর্করায় পরিণত হচ্ছে। কিন্তু রোজার সময় দিনের বেলায় যেহেতু আপনি কিছুই খেতে বা পান করতে পারছেন না, তাই রোজা ভাঙার পর অবশ্যই আপনাকে সেটার ঘাটতি পূরণের জন্য প্রচুর পানি পান করতে হবে। নইলে আপনি মারাত্মক পানিশূন্যতায় আক্রান্ত হতে পারেন। বিশেষ করে গরমের দিনে যদি শরীরে ঘাম হয়।
আর যে খাবার আপনি খাবেন, সেটাতেও যথেষ্ট শক্তিদায়ক খাবার থাকতে হবে। যেমন কার্বোহাইড্রেট বা শর্করা এবং চর্বি। একটা ভারসাম্যপূর্ণ খাবার খুব গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে সব ধরণের পুষ্টি, প্রোটিন বা আমিষ, লবণ এবং পানি থাকবে।
৮ হতে ১৫ রোজা: অভ্যস্ত হয়ে উঠছে শরীর
এই পর্যায়ে এসে আপনি নিশ্চয়ই অনুভব করতে পারছেন যে আপনার শরীর-মন ভালো লাগছে, কারণ রোজার সঙ্গে আপনার শরীর মানিয়ে নিতে শুরু করেছে।
ক্যামব্রিজের এডেনব্রুকস হাসপাতালের 'অ্যানেসথেসিয়া অ্যান্ড ইনটেনসিভ কেয়ার মেডিসিনের কনসালট্যান্ট ড: রাজিন মাহরুফ বলেন, এর অন্যান্য সুফলও আছে। সাধারণত দৈনন্দিন জীবনে আমরা অনেক বেশি ক্যালরিযুক্ত খাবার খাই এবং এর ফলে আমাদের শরীর অন্য অনেক কাজ ঠিকমতো করতে পারে না, যেমন ধরুন শরীর নিজেই নিজেকে সারিয়ে তুলতে পারে। কিন্তু রোজার সময় যেহেতু আমরা উপোস থাকছি, তাই শরীর তখন অন্যান্য কাজের দিকে মনোযোগ দিতে পারে। কাজেই রোজা কিন্তু শরীরের জন্য বেশ উপকারী। এটি শরীরের ক্ষত সারিয়ে তোলা বা সংক্রমণ রোধে সাহায্য করতে পারে।
১৬ হতে ৩০ রোজা: ভারমুক্ত শরীর
রমজান মাসের দ্বিতীয়ার্ধে আপনার শরীর কিন্তু পুরোপুরি রোজার সঙ্গে মানিয়ে নেবে। আপনার শরীরের পাচকতন্ত্র, যকৃৎ, কিডনি এবং দেহত্বক এখন এক ধরণের পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে যাবে। সেখানে থেকে সব দূষিত বস্তু বেরিয়ে আপনার শরীর যেন শুদ্ধ হয়ে উঠবে। এ সময় আপনার শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ তাদের পূর্ণ কর্মক্ষমতা ফিরে পাবে। আপনার স্মৃতি এবং মনোযোগের উন্নতি হবে এবং আপনি যেন শরীরে অনেক শক্তি পাবেন।
ড. মাহরুফ বলেছেন, শরীরের শক্তি জোগানোর জন্য আপনার আমিষের ওপর নির্ভরশীল হওয়া ঠিক হবে না। যখন আপনার শরীর 'ক্ষুধার্ত' থাকছে তখন এটি শক্তির জন্য দেহের মাংসপেশীকে ব্যবহার করছে। এবং এটি ঘটে যখন একটানা বহুদিন বা কয়েক সপ্তাহ ধরে আপনি উপোস থাকছেন বা রোজা রাখছেন।
যেহেতু রোজার সময় কেবল দিনের বেলাতেই আপনাকে না খেয়ে থাকতে হয়, তাই আমাদের শরীরের চাহিদা মেটানোর জন্য যথেষ্ট খাবার এবং তরল বা পানীয় গ্রহণের সুযোগ থাকছে রোজা ভাঙ্গার পর। এটি আমাদের মাংসপেশীকে রক্ষা করছে এবং একই সঙ্গে আমাদের আবার ওজন কমাতেও সাহায্য করছে।
তাহলে রোজা রাখা কি স্বাস্থ্যের জন্য ভালো?
ড. মাহরুফ বলেন, অবশ্যই, তবে একটা ব্যাপার আছে। রোজা রাখা শরীরের জন্য ভালো কারণ আমরা কী খাই এবং কখন খাই সেটার ওপর আমাদের মনোযোগ দিতে সাহায্য করে। কিন্তু একমাসের রোজা রাখা হয়তো ভালো। কিন্তু একটানা রোজা রেখে যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া যাবে না।
শরীরের ওজন কমানোর জন্য একটানা রোজা রাখা কোনো উপায় হতে পারে না। কারণ একটা সময় আপনার শরীর চর্বি গলিয়ে তা শক্তিতে পরিণত করার কাজ বন্ধ করে দেবে। তখন এটি শক্তির জন্য নির্ভর করবে মাংসপেশীর ওপর। এটা স্বাস্থ্যের জন্য ভালো নয়। কারণ আপনার শরীর তখন ক্ষুধায় ভুগবে।
ড. মাহরুফের পরামর্শ হচ্ছে রমজান মাসের পর মাঝে মধ্যে অন্যধরনের উপোস করা যেতে পারে। যেমন ৫ : ২ ডায়েট (পাঁচদিন কম খেয়ে দুদিন ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করা)। যেখানে কয়েকদিন রোজা রেখে আবার স্বাস্থ্যসম্মতভাবে খাওয়া-দাওয়া করা যেতে পারে।
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: