আজ পহেলা বৈশাখ। বাংলা বর্ষপঞ্জিতে এসেছে নতুন বছর— ১৪২৮। বিগত বছরের জীর্ণ-পুরাতন সরে জীবনে আসুক নতুন সম্ভাবনা। বৈশ্বিক মহামারির এই দিনে নতুন বছর আনুক মুক্তির নতুন বার্তা। কবিগুরুর বাণী— ‘মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা’ ধ্বনিত হোক চারপাশে।
বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা’র প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পহেলা বৈশাখ আমাদের সব সংকীর্ণতা, কুপমণ্ডকতা ত্যাগ করে উদারনৈতিক জীবন-ব্যবস্থা গড়তে উদ্বুদ্ধ করে। আমাদের মনের ভেতরের সব ক্লেদ, জীর্ণতা দূর করে আমাদের নতুন উদ্যোমে বাঁচার অনুপ্রেরণা দেয়। আমরা যে বাঙালি, বিশ্বের বুকে এক গর্বিত জাতি, পহেলা বৈশাখের বর্ষবরণে আমাদের মধ্যে এই স্বাজাত্যবোধ ও বাঙালিয়ানা নতুন করে প্রাণ পায়, উজ্জীবিত হয়।
এতে আরও বলা হয়, অন্যদিকে, পহেলা বৈশাখ বাঙালির একটি সার্বজনীন লোকউৎসব। আনন্দঘন পরিবেশে নতুন বছরকে বরণ করে নেওয়ার দিন। কল্যাণ ও নতুন জীবনের প্রতীক নববর্ষ। অতীতের ভুলত্রুটি ও ব্যর্থতার গ্লানি ভুলে নতুন করে সুখ-শান্তি ও সমৃদ্ধি কামনায় উদযাপিত হয় নববর্ষ। আজ সরকারি ছুটি।
পহেলা বৈশাখে বর্ণিল উৎসবে মেতে ওঠার চিরায়ত নিয়ম থাকলেও দেশে দ্বিতীয়বারের মতো করোনার সংক্রমণ রোধ করতে সবধরনের সমাগমের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে সরকার। সারা দেশে আজ থেকে সাত দিনের সর্বাত্মক লকডাউন ঘোষণা করা হয়েছে।
এর আগে গত ৫ এপ্রিল থেকে ১১ এপ্রিল পর্যন্ত প্রথম লকডাউন আরও দুই দিন বর্ধিত করে ১৪ এপ্রিল ভোর পর্যন্ত চলমান করা হয়।
করোনার দ্বিতীয় ঢেউতে সংক্রমণ অনেক বেশি হওয়ায় গত বছরের মতো এবারও বর্ষবরণ উৎসবের ওপর সরকার বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। একাত্তরের পর গত বছর নববর্ষের প্রখম প্রহরে রমনার বটমূলে ছায়ানটের অনুষ্ঠান হয়নি। তারই ধারাবাহিকতায় এ বছরও থাকছে না ছায়ানটের নতুন বছরের বন্দনা।
এক সময় নববর্ষ পালিত হতো আর্তব উৎসব বা ঋতুধর্মী উৎসব হিসেবে। তখন এর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল কৃষির, কারণ কৃষিকাজ ছিল ঋতুনির্ভর। পরে কৃষিকাজ ও খাজনা আদায়ের সুবিধার জন্য মোঘল সম্রাট আকবরের সময়ে বাংলা সন গণনার শুরু হয়। হিজরি চান্দ্রসন ও বাংলা সৌর সনের ওপর ভিত্তি করে প্রবর্তিত হয় নতুন এই বাংলা সন।
অতীতে বাংলা নববর্ষের মূল উৎসব ছিল ‘হালখাতা’। এটি পুরোপুরিই একটি অর্থনৈতিক ব্যাপার। গ্রামে-গঞ্জে-নগরে ব্যবসায়ীরা নববর্ষের প্রারম্ভে তাদের পুরানো হিসাব-নিকাশ সম্পন্ন করে হিসাবের নতুন খাতা খুলতেন। এ উপলক্ষে তারা নতুন-পুরাতন ক্রেতাদের আমন্ত্রণ জানিয়ে মিষ্টি বিতরণ করতেন এবং নতুনভাবে তাদের সঙ্গে ব্যবসায়িক যোগসূত্র স্থাপন করতেন। চিরায়ত এ অনুষ্ঠানটি আজও পালিত হয়।
মূলত ১৫৫৬ সালে কার্যকর হওয়া বাংলা সন প্রথমদিকে পরিচিত ছিল ফসলি সন নামে, পরে তা পরিচিত হয় বঙ্গাব্দ নামে। কৃষিভিত্তিক গ্রামীণ সমাজের সঙ্গে বাংলাবর্ষের ইতিহাস জড়িয়ে থাকলেও এর সঙ্গে রাজনৈতিক ইতিহাসেরও সংযোগ ঘটেছে।
পাকিস্তান শাসনামলে বাঙালি জাতীয়তাবাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি হয় বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের। আর ষাটের দশকের শেষে তা বিশেষ মাত্রা পায় রমনা বটমূলে ছায়ানটের আয়োজনের মাধ্যমে। সেসময় ঢাকায় নাগরিক পর্যায়ে ছায়ানটের উদ্যোগে সীমিত আকারে বর্ষবরণ শুরু হয়। আমাদের মহান স্বাধীনতার পর ধীরে ধীরে এই উৎসব নাগরিক জীবনে প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করে।
পহেলা বৈশাখের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে বাঙালির অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক চেতনার বহিঃপ্রকাশ ঘটতে থাকে। কালক্রমে বর্ষবরণ অনুষ্ঠান এখন শুধু আনন্দ-উল্লাসের উৎসব নয়, এটি বাঙালি সংস্কৃতির একটি শক্তিশালী ধারক-বাহক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
শুধু তাই নয়, উৎসবের পাশাপাশি স্বৈরাচার-অপশক্তির বিরুদ্ধে প্রতিবাদও এসেছে পহেলা বৈশাখের আয়োজনে। ১৯৮৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে বের হয় প্রথম ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’। যা ২০১৬ সালের ৩০ নভেম্বর ইউনেস্কো এ শোভাযাত্রাকে বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের মর্যাদা দেয়। তবে, এ বছর মঙ্গল শোভাযাত্রার অনুষ্ঠানটি হচ্ছে না।
বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণীতে দেশবাসীসহ বাঙালিদের আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানিয়েছেন।
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: