বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে অন্যতম কলঙ্কজনক অধ্যায় ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলা। দেশের ইতিহাসের সেই নৃশংসতম হত্যাযজ্ঞের ১৮তম বার্ষিকী আজ।
২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয় প্রাঙ্গণে সন্ত্রাসীবিরোধী সমাবেশে বক্তব্য রাখতে গিয়ে সন্ত্রাসের শিকার হন আওয়ামী লীগ সভাপতি। হামলার ধরন ও লক্ষ্যস্থল থেকে এটা স্পষ্টত যে, শেখ হাসিনাকে হত্যা করাই ছিল ওই গ্রেনেড হামলা ও গুলিবর্ষণের উদ্দেশ্য। দলীয় নেতা-কর্মীদের তৈরি মানববর্মে শেখ হাসিনা রক্ষা পেলেও ওই হামলায় দলের মহিলা বিষয়ক সম্পাদক ও প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের স্ত্রী আইভি রহমানসহ ২২ জন নেতা-কর্মী প্রাণ হারান।
তখন ক্ষমতায় ছিল বিএনপি-জামায়াত নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকার। সেদিন “সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ ও দুর্নীতি বিরোধী” শান্তি মিছিলের আয়োজন করেছিল তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগ। আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এতে প্রধান অতিথি ছিলেন। সন্ত্রাসবিরোধী শান্তি মিছিলের আগে বঙ্গবন্ধু এভিনিউর সামনে স্থাপিত অস্থায়ী ট্রাকমঞ্চে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা শেষ হওয়ার পরপরই তাকে টার্গেট করে উপর্যুপরি গ্রেনেড নিক্ষেপ করা হয়। বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হতে থাকে একের পর এক গ্রেনেড। কিছু বুঝে ওঠার আগেই ১৩টি গ্রেনেড বিস্ফোরণের বীভৎসতায় মুহূর্তেই মানুষের রক্ত-মাংসের স্তূপে পরিণত হয় সমাবেশস্থল। বঙ্গবন্ধু এভিনিউ পরিণত এক মৃত্যুপুরীতে। স্প্লিন্টারের আঘাতে মানুষের হাত-পাসহ শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ছিন্নভিন্ন হয়ে চারদিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে। চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকতে দেখা যায় রক্তাক্ত নিথর দেহ। লাশ আর রক্তে ভেসে যায় বঙ্গবন্ধু এভিনিউর সামনের পিচঢালা পথ। নিহত-আহতদের জুতা-স্যান্ডেল ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে। মুহূর্তের মধ্যে পুরো এলাকা ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে যায়। ভেসে আসে আহত ও মৃত্যুপ্রায় মানুষের গননবিদারী আর্তচিৎকার। সেদিন রাজধানীর প্রতিটি হাসপাতালে আহতদের তিল ধারণের স্থান ছিল না। ভাগ্যগুণে নারকীয় গ্রেনেড হামলায় অলৌকিকভাবে প্রাণে বেঁচে গেলেও শেখ হাসিনার দুই কানের শ্রবণশক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। হামলার প্রধান লক্ষ্য শেখ হাসিনা বেঁচে গেছেন দেখে তার গাড়ি লক্ষ্য করে ঘাতকরা ১২ রাউন্ড গুলি করে। তবে টার্গেট করা গুলি ভেদ করতে পারেনি বঙ্গবন্ধুকন্যাকে বহনকারী বুলেটপ্রুফ গাড়ির কাঁচ। হামলার পরপরই শেখ হাসিনাকে কর্ডন করে গাড়িতে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় তার তৎকালীন বাসভবন সুধা সদনে। ২১ আগস্টের রক্তাক্ত ঘটনায় ঘটনাস্থলেই নিহত হন ১৬ জন। পরে সব মিলিয়ে নিহতের সংখ্যা দাঁড়ায় ২৪ জনে।
ঘটনায় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মী ছাড়াও আহত হয়েছিলেন বিভিন্ন প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সাংবাদিকরা।
গ্রেনেড হামলার পর ভয়, শঙ্কা ও ত্রাস গ্রাস করে ফেলে গোটা রাজধানীকে। এই গণহত্যার উত্তেজনা ও শোক আছড়ে পড়ে দেশ-বিদেশে। হামলার পর আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা নিজে বাঁচতে ও অন্যদের বাঁচাতে যখন ব্যস্ত হয়ে পড়ে, ঠিক তখনই পুলিশ বিক্ষোভ মিছিলের ওপর বেধড়ক লাঠি-টিয়ার শেল চার্জ করে। এতে নষ্ট হয় সেই রোমহর্ষক ঘটনার অনেক আলামত।
পরবর্তিতে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা ও প্রত্যক্ষ মদতে ওই ঘটনা ধামাচাপা, “জজ মিয়া” নাটক সাজিয়ে ভিন্ন খাতে প্রবাহিতসহ হেন কোনও কাজ নেই, যা করেনি বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার।
দীর্ঘ ১৪ বছর পর ২০১৮ সালে মাননীয় আদালত ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার রায় প্রদান করেন। রায়ে ১৯ জনের মৃত্যুদণ্ড, ১৯ জনের যাবজ্জীবন এবং বাকি ১১ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয়। মামলাটি এখনও উচ্চ আদালতে বিচারাধীন।
গ্রেনেড হামলার বিচারের রায়ে তৎকালীন ক্ষমতাসীন বিএনপি জোট সরকারের মন্ত্রী ও সরকারের কর্মকর্তার সম্পৃক্ততায় প্রমাণ মেলে ওই সরকারের প্রত্যক্ষ মদদেই হামলাটি পরিচালিত হয়েছিল।
বাঙালি জাতি আজ শ্রদ্ধাবনতচিত্তে ইতিহাসের ভয়াবহতম গ্রেনেড হামলার ১৮তম বার্ষিকী পালন করবে। দিবসটি উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাণী দিয়েছেন।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। চলমান কোভিড-১৯ মহামারিতে স্বাস্থ্যবিধি মেনে সারাদেশে দিবসটি পালনের কর্মসূচি গ্রহণ করেছে দলটি।
দলটির পক্ষ থেকে গণমাধ্যমে পাঠানো বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ২১ আগস্টে ভয়াবহ গ্রেনেড হামলায় নিহতদের স্মরণে আগামীকাল সকাল সাড়ে দশটায় আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে।
এতে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা উপস্থিত থাকবেন।
সকালে প্রথমে বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ের দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে ২১ আগস্টে নিহতদের স্মরণে নির্মিত প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা জানানো হবে।
২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় নিহতদের সম্মান জানাতে স্বাস্থ্যবিধি মেনে আওয়ামী লীগের সকল নেতা-কর্মী, সমর্থক, শুভাকাঙ্খী ও সর্বস্তরের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনকে দিবসটি পালনের আহ্বান জানান দলটির সাধারণ সম্পাদক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।
উল্লেখ্য, ২১ আগস্টের হামলায় হামলায় আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় মহিলা বিষয়ক সম্পাদক ও সাবেক রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের স্ত্রী আইভি রহমানসহ ২৪ জন নিহত হন। এছাড়া আহত হন আরও পাঁচ শতাধিক মানুষ, যাদের অনেকে আজীবনের জন্য পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন।
সেদিনের হামলায় আরও যারা নিহত হয়েছিলেন তাদের মধ্যে রয়েছে তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেতার নিরাপত্তা কর্মী ল্যান্স করপোরাল (অবসরপ্রাপ্ত) মাহবুবুর রশিদ, আবুল কালাম আজাদ, রেজিনা বেগম, নাসির উদ্দিন সরদার, আতিক সরকার, আব্দুল কুদ্দস পাটোয়ারি, আমিনুল ইসলাম মোয়াজ্জেম, বেলাল হোসেন, মামুন মৃধা, রতন শিকদার, লিটন মুন্সি, হাসিনা মমতাজ রীনা, সুফিয়া বেগম, রফিকুল ইসলাম, মোশতাক আহমেদ সেন্টু, মো. হানিফ, আবুল কাশেম, জেহাদ আলী, মমিন আলী, এম শামছুদ্দিন এবং ইসহাক মিয়া।
এছাড়া গ্রেনেড হামলায় স্প্রিন্টারের আঘাতে মারাত্মক আহত হয়েছিলেন তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেতা ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, আমির হোসেন আমু, আব্দুর রাজ্জাক, সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত, ওবায়দুল কাদের, মোহাম্মদ হানিফ, অধ্যাপক আবু সায়্যিদ এবং এএফএম বাহাউদ্দিন নাসিম।
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: