এমভি অভিযান-১০ নামের লঞ্চটি বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৬টায় ঢাকা থেকে বরগুনা যাচ্ছিল। ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে গতকাল দিবাগত রাত তিনটার দিকে এটিতে আগুন ধরে যায়। অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় এখন পর্যন্ত ৪০ জনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত হওয়া গেছে। ঘটনার পর বরগুনার ১০ যাত্রী বেঁচে ফিরলেও এখনো নিখোঁজ আছেন অনেকে। দগ্ধদের মধ্যে ৭২ জনকে বরিশাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। বাকিদের আশপাশের বিভিন্ন হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে।
লঞ্চের বেঁচে ফেরা কয়েকজন যাত্রীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ঢাকার সদরঘাট থেকে গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৬টায় এমভি অভিযান-১০ নামে লঞ্চটি যখন বরগুনার উদ্দেশে যাত্রা করে, তখন থেকেই এর গতি ছিল বেপরোয়া। ইঞ্জিনে ত্রুটি থাকায় চারজন টেকনিশিয়ান ত্রুটি মেরামতে কাজ করছিলেন। এ জন্য পুরো গতিতে দুটি ইঞ্জিন চালিয়ে ট্রায়াল দেওয়া হচ্ছিল। আর এতেই মূলত ইঞ্জিনের অতিরিক্ত তাপে আগুন ধরে যায়। আগুন লেগে যাওয়ার পর নেভানোর কোনো চেষ্টা না করে লঞ্চটির শ্রমিক-কর্মচারী ও মালিক লঞ্চ থেকে সটকে পড়েন।
লঞ্চের যাত্রী বরগুনার ব্যবসায়ী সগির হোসেন হাওলাদার বলেন, আমি ওই লঞ্চের তিনতলার কেবিনের যাত্রী ছিলেন। আমি লঞ্চে উঠেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। লঞ্চটি অর্ধেকের বেশি পুড়ে যাওয়ার পর প্রচণ্ড উত্তাপ আর ধোঁয়ায় দম আটকে যাওয়ায় ঘুম ভেঙে যায় আমার। এরপর বাইরে নেমে দেখি চারদিকে আগুন। আমি লঞ্চের পাশের ত্রিপলের রশি বেয়ে দ্রুত দোতলায় নামি। সেখানে অনেক নারী, শিশুকে অজ্ঞান ও দগ্ধ অবস্থায় পড়ে থাকতে থাকি। একটি ফ্যামিলি কেবিনে দুই শিশু ও এক নারীর দগ্ধ নিথর দেহ পড়ে থাকতে দেখি। ওই পরিস্থিতিতে কী করবো ভেবে দিশেহারা। পরে নদীতে ঝাঁপ দেই। পরে স্থানীয় লোকজন আমাকে উদ্ধার করেন।
সগির হোসেন বলেন, লঞ্চটির ঢাকার ঘাট ছাড়ার পর তিনি ইঞ্জিনকক্ষের কাছে গিয়েছিলেন। তখন ইঞ্জিনের বেপরোয়া গতি তুলতে চারজন টেকনিশিয়ানকে দেখতে পান। এ সময় তিনি তাঁর মুঠোফোনে ইঞ্জিনের ছবিও তোলেন।
তিনি বলেন, লঞ্চটিতে অগ্নিনির্বাপকের কোনো ব্যবস্থা ছিল না। আর আগুন লাগার পরপরই মালিক ও স্টাফরা যাত্রীদের রেখে লঞ্চ থেকে সটকে পড়েন।
কয়েকজন যাত্রী বলেন, লঞ্চটির ইঞ্জিনের ত্রুটি থাকায় চারজন ইঞ্জিন মেরামতকারী টেকনিশিয়ান লঞ্চটির ইঞ্জিনকক্ষে ছিলেন। তাঁরাই মূলত পুরো গতিতে লঞ্চটি চালাচ্ছিলেন। ইঞ্জিনে গ্যাস হওয়ায় বেশ কয়েক দিন আগে থেকেই ইঞ্জিন প্রচণ্ড গরম হচ্ছিল। ইঞ্জিনের ত্রুটি খুঁজে পেতে পুরো গতিতে দুটি ইঞ্জিনই চালাচ্ছিলেন তাঁরা। বেপরোয়া গতির কারণে লঞ্চটি কাঁপছিল।
প্রত্যক্ষদর্শী বরগুনার আরেক যাত্রী জাহিদুল ইসলাম বলেন, রাত পৌনে একটায় বরিশাল নৌবন্দর ত্যাগ করার পর লঞ্চটির পুরো ডেক উত্তপ্ত হয়ে যায়। শীত থাকায় চারপাশ ত্রিপল দিয়ে আটকানো ছিল। রাত আড়াইটার দিকে লঞ্চটি ঝালকাঠি স্টেশন থেকে দেউরী এলাকায় আসতেই আগুন লাগে। কিছু দূরে এলে ইঞ্জিনকক্ষে আগুন ধরে যায়। এরপর আগুন পুরো লঞ্চের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। লঞ্চের ২০ ব্যারেল ডিজেল, নিচতলায় দুটি মোটরসাইকেল এবং রান্নার জন্য রাখা কয়েকটি গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ হয়। একই সঙ্গে ভিআইপি কেবিনের এসির কম্প্রেসারগুলোও একে একে বিস্ফোরিত হয়।
যাত্রীদের অভিযোগ, লঞ্চটির ইঞ্জিনে ত্রুটি মেরামত করতে লঞ্চ কর্তৃপক্ষ যাত্রীদের ছাড়া ইঞ্জিনের ট্রায়াল দিতে পারত। কিন্তু প্রায় ৭০০ যাত্রী নিয়ে এই ট্রায়াল দেওয়ার কারণেই এতগুলো মানুষের প্রাণহানি ও দগ্ধ হলো।
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: