ইউরোপের দেশগুলোতে এপ্রিল মাসের প্রথম দিনটি বেশ ঘটা করে পালন করা হয়। এদিনে একে অপরকে চমকে দিয়ে 'বোকা' বানাতে চায়। এদিন অনেকে কিছুটা বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করে। অন্যথায় কারো না কারো কাছে বোকা হতে হয়। তবে যাকে বোকা বানানো হয়, তাকে শেষে সবাই মিলে চিৎকার করে জানিয়ে দেয় ‘এপ্রিল ফুল’। এ দিনটিকে তাই বলা হয় অল ফুলস ডে, বাংলায় 'বোকা বানানো'র দিন।
এইদিনে পরিবারের ছোটরা সাধারণত বড়দের সঙ্গে নানাভাবে মজা করে বোকা বানানোর চেষ্টা করে। আবার বন্ধু বা সহকর্মীরাও একে অন্যের সঙ্গে মজা করে। তবে যাকে বোকা বানানো হয়, তাকে শেষে সবাই মিলে চিৎকার করে জানিয়ে দেয় 'এপ্রিল ফুল'।
এমনকি বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম ফলাও করে ভুয়া ও ভুল সংবাদ ছাপানো হয় এদিনে, পরদিন অবশ্য সেটার সংশোধনী দিয়ে জানিয়ে দেয় খবরটা আসলে 'এপ্রিল ফুল' ছিল। তবে বাংলাদেশের মতো দেশগুলোতে এই প্রচলন খুব একটা দেখা যায় না।
মুসলমানদের ধারণা
বাংলাদেশে একটা প্রচলিত ধারণা এপ্রিল ফুলের সঙ্গে আসলে মুসলমানদের বোকা বানানোর ইতিহাস জড়িয়ে আছে। অনেকেই মনে করেন ১৫শতকের শেষ দিকে স্পেনে মুসলিম শাসনের অবসান ঘটান রাজা ফার্দিনান্দ ও রানি ইসাবেলা। তারা স্পেনের মুসলিম অধ্যুষিত গ্রানাডায় হামলা করেন এবং পরাজিত অসংখ্য মুসলিম নারী, পুরুষ ও শিশুকে মসজিদে আটকে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে মারেন। আর সেদিনটি ছিল পহেলা এপ্রিল।
কিন্তু এর কোনো ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই বলে জানিযেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ছিদ্দিকুর রহমান খান।
তিনি যুক্তারাজ্যভিত্তিক সংবাদমাধ্যম বিবিসিকে বলেন, এটি আমরাও শুনেছি এবং এটি একরকম আমাদের বিশ্বাসের অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু আমি ইতিহাসের ছাত্র হিসেবে যখন স্পেনের ইতিহাস পড়েছি, দেখেছি যে সেসময় গ্রানাডার শাসক ছিলেন দ্বাদশ মোহাম্মদ। তার কাছ থেকেই ফার্দিনান্দ ও ইসাবেলা গ্রানাডা দখল করে নেন। আর এ ঘটনাটি ঘটেছিল জানুয়ারি মাসের ২ তারিখে। কোন কোন সূত্র বলে জানুয়ারি মাসের ১ তারিখ। এবং এটি দুই পক্ষের মধ্যে আনুষ্ঠনিক চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে হয়েছিল।
তিনি জানান, সেই সময়ে ফার্দিনান্দ ও ইসাবেলা মুসলমানদের ওপর নির্যাতন করেছে, ইহুদিদের ওপরও করেছে, কিন্তু এপ্রিল ফুলের যে ট্র্যাজেডির কথা বলা হয় সেটার সঙ্গে তার কোনো সত্যতা পাওয়া যায় না।
তিনি বলেন, ইতিহাসে আমরা যে বইগুলো পড়েছি সেখানে কোথাও ঐ বর্ণনা পাইনি। আমাদের কাছে মনে হয় এই ঘটনা নিয়ে একটা মিথ তৈরি করা হয়েছে, যার সঙ্গে কোনো ঐতিহাসিক সংযোগ নেই।
শিক্ষক আরো বলেন, অন্যদিকে গূরুত্ব দিয়ে অবশ্য মুসলমানরা এটি উদযাপন নাও করতে পারে। কারণ ইসলাম ধর্ম মিথ্যা বলা, প্রতারিত করা বা কাউকে বোকা বানানো সমর্থন করে না।
এপ্রিল ফুলের উৎপত্তি
কিন্তু এই এপ্রিল ফুলের উৎপত্তি কীভাবে? কেনইবা এর নাম এপ্রিল ফুল হল? অনেকগুলো মত এ ব্যাপারে প্রচলিত আছে। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক, ব্রিটানিকা, হিস্ট্রিসহ বেশ কিছু ওয়েবসাইট বলছে এপ্রিল ফুলের উৎপত্তি হয় ফ্রান্সে। আর সেটা ১৫০০ শতকে, যখন ক্যালেন্ডার বদল ঘটে।
তার আগে পর্যন্ত জুলিয়াস সিজার প্রবর্তিত জুলিয়ান ক্যালেন্ডার ব্যবহার হয়ে আসছিল। যে ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ঋতুর সঙ্গে মিল রেখে নতুন বছর শুরু হতো মার্চের শেষে বা এপ্রিলের শুরুর দিকে। কিন্তু ফ্রান্স প্রথম গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার গ্রহণ করে। যে ক্যালেন্ডার অনুযায়ী পহেলা জানুয়ারি ধরা হয় বছরের প্রথম দিন। স্বাভাবিকভাবেই সেই খবর সব জায়গায় পৌঁছাতে আরো বেশ কিছুদিন লেগে যায়। অনেকে আবার সিদ্ধান্ত নেয় তারা জুলিয়ান ক্যালেন্ডার অনুযায়ীই চলবেন। ফলে পহেলা জানুয়ারির পরিবর্তে অনেকেই আগের মতো মার্চের শেষে বা এপ্রিলের শুরুতে নতুন বছর উদযাপন করতে থাকে।
আর সেই বিষয়টি বেশ হাস্যরস ও আনন্দের খোরাক হয়ে দাঁড়ায়। ফলে যারা এরই মধ্যে পহেলা জানুয়ারি নতুন বছর উদযাপন করছে তারা তখন তাদের ‘এপ্রিল ফুলস’ বলে ডাকতে থাকে। ফ্রান্সে বা অন্যান্য দেশে ফ্রেঞ্চভাষী মানুষদের মাঝে এই দিনটি অবশ্য ‘এপ্রিল ফিশ’ হিসেবেই বেশি পরিচিত।
ইতিহাসবিদরা প্রাচীন রোমের সাথেও এপ্রিল ফুলের যোগসূত্র দেখে থাকেন। মার্চের শেষদিকে সেখানে দেব-দেবীদের মাতা খ্যাত সাইবেলের অনুসারীরা একটি উৎসব পালন করতেন যার নাম ছিল হিলারিয়া। লাতিন এই শব্দের অর্থ হল আনন্দদায়ক। এদিনে মানুষ বিভিন্ন ছদ্মবেশ ধারণ করে অন্যদের সাথে মজায় লিপ্ত হত। আর সেখান থেকেই এপ্রিল ফুলের শুরু বলে অনুমান অনেকের।
এসটি/এসকে
জনপ্রিয় খবর
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: