ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস

‘স্বাধীনতাও চাই, বঙ্গবন্ধুকেও চাই’

সময় ট্রিবিউন | ১৮ এপ্রিল ২০২১, ০৬:৫৮

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তোফায়েল আহমেদ (ফাইল ছবি)

এ বছর সতেরোই এপ্রিল ‘মুজিবনগর দিবস’-এর সুবর্ণজয়ন্তী। প্রতি বছর আমাদের জাতীয় জীবনে ‘মুজিবনগর দিবস’ ফিরে আসে এবং যথাযোগ্য মর্যাদায় আমরা দিনটি পালন করি। কিন্তু এবার পরিস্থিতি ভিন্ন। ‘করোনাভাইরাস’ তথা ‘কোভিড-১৯’ মহামারি আকারে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ায় বাংলাদেশও আক্রান্ত। ফলে, জনস্বাস্থ্য রক্ষায় সতর্কতার অংশ হিসেবে ‘জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ’ তথা ‘মুজিববর্ষ’, ‘স্বাধীনতা দিবস’, ‘বাংলা নববর্ষ’ এবং ‘মুজিবনগর দিবস’ পালন উপলক্ষে গৃহীত রাষ্ট্রীয় ও দলীয় অনুষ্ঠান সীমিতকরণ বা স্থগিত করা হয়েছে। আশা করি, দেশের সর্বস্তরের জনসাধারণ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশাবলী অক্ষরে অক্ষরে পালনের মধ্য দিয়ে এই ভয়াবহ দুর্যোগ কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হবেন।

১৭৫৭-এর তেইশে জুন পলাশীর আম্রকাননে স্বাধীনতার যে সূর্য অস্তমিত হয়েছিল, মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ১৯৭১-এর এই দিনে মেহেরপুরের আম্রকানন মুজিবনগরে স্বাধীনতার সেই সূর্য উদিত হয়েছিল। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রথম সরকারের শপথ অনুষ্ঠানের স্মৃতিকথা লিখতে বসে আজ কতো কথা আমার মানসপটে ভেসে উঠছে।

পঁচিশে মার্চ  দিনটির কথা বিশেষভাবে মনে পড়ে। এদিন মণি ভাই এবং আমি বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে বিদায় নেই। বিদায়ের প্রাক্কালে তিনি বুকে টেনে আদর করে বলেছিলেন, ‘ভালো থেকো। আমার দেশ স্বাধীন হবেই। তোমাদের যে নির্দেশ দিয়েছি তা যথাযথভাবে পালন করো।’ পঁচিশে মার্চ রাতে আমরা ছিলাম মতিঝিলের আরামবাগে মণি ভাইয়ের বাসভবনে। রাত বারোটায় অর্থাৎ জিরো আওয়ারে পাকিস্তান সেনাবাহিনী পূর্বপরিকল্পিত ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে গণহত্যা শুরু করে। চারদিকে প্রচণ্ড গোলাগুলি। এক রাতেই পাকবাহিনী লক্ষাধিক লোককে হত্যা করে। যা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল।

ছাব্বিশে মার্চ জাতির উদ্দেশে দেওয়া ইয়াহিয়া খানের ভাষণ শুনি। ভাষণে তিনি জাতির জনককে ‘বিশ্বাসঘাতক’ আখ্যায়িত করে বলেছিলেন, ‘শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করা হয়েছে। শেখ মুজিবসহ আওয়ামী লীগ নেতাদের আরও আগেই গ্রেফতার করা উচিত ছিল, আমি ভুল করেছি। দিস টাইম হি উইল নট গো আনপানিস্ড।’ তারপর কারফিউ জারি হয় এবং ছাব্বিশে মার্চেই চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র থেকে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এম এ হান্নান বঙ্গবন্ধু প্রদত্ত ‘স্বাধীনতার ঘোষণা’র কথা বারবার প্রচার করে বলেছেন, ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ‘স্বাধীনতার ঘোষণা’ প্রদান করে বলেছেন, ‘এটাই হয়তো আমার শেষ বার্তা। আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। বাংলাদেশের মানুষ যে যেখানে আছেন, আপনাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে সেনাবাহিনীর দখলদারির মোকাবিলা করার জন্য আমি আহ্বান জানাচ্ছি। পাকিস্তান দখলদার বাহিনীর শেষ সৈন্যটিকে বাংলাদেশের মাটি থেকে উৎখাত করা এবং চূড়ান্ত বিজয় না হওয়া পর্যন্ত আপনাদেরকে সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে।’

এরপর দুই ঘণ্টার জন্য কারফিউ শিথিল হলে আমরা কেরানীগঞ্জে আমাদের সাবেক সংসদ সদস্য বোরহানউদ্দিন গগনের বাড়িতে আশ্রয় গ্রহণ করি। জাতীয় নেতা ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী এবং এএইচএম কামারুজ্জামান সাহেব, মণি ভাই, সিরাজ ভাই, রাজ্জাক ভাই এবং আমিসহ স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দ সেখানে উপস্থিত ছিলেন। সিদ্ধান্ত হলো মণি ভাই ও আমি, মনসুর আলী সাহেব এবং কামারুজ্জামান সাহেবকে নিয়ে আমরা ভারতের দিকে যাবো। আমাদের এই যাত্রাপথ আগেই ঠিক করা ছিল। অসহযোগ আন্দোলন চলাকালে সিরাজগঞ্জের কাজিপুর থেকে নির্বাচিত এমসিএ ডা. আবু হেনাকে বঙ্গবন্ধু যে পথে কলকাতা পাঠিয়েছিলেন, সেই পথেই আবু হেনা আমাদের নিয়ে গিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু আমাদের জন্য আগেই বাসস্থান নির্ধারণ করে রেখেছেন। ক্ষমতা হস্তান্তর প্রশ্নে ভুট্টো যখন টাল-বাহানা শুরু করে তখন ’৭১-এর আঠারোই ফেব্রুয়ারি ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরে জাতির জনক জাতীয় চার নেতার সামনে আমাদের এই ঠিকানা মুখস্থ করিয়েছিলেন, ‘সানি ভিলা, ২১ নং রাজেন্দ্র রোড, নর্দার্ন পার্ক, ভবানীপুর, কলকাতা।’ বলেছিলেন, ‘এখানে  তোমরা থাকবে। তোমাদের জন্য সব ব্যবস্থা আমি করে রেখেছি।’ ২৯ মার্চ কেরানিগঞ্জ থেকে দোহার-নবাবগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া হয়ে ৪ এপ্রিল আমরা ভারতের মাটি স্পর্শ করি এবং সানি ভিলায় আশ্রয় নেই। এখানে আমাদের সাথে দেখা করতে আসেন-পরে বাংলাদেশ সরকারের প্রথম প্রধানমন্ত্রী-জাতীয় নেতা তাজউদ্দীন আহমদ এবং ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম।

এপ্রিলের ১০ তারিখ জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদে নবনির্বাচিত সদস্যদের সমন্বয়ে ‘বাংলাদেশ গণপরিষদ’ গঠন করে, মেহেরপুরের বৈদ্যনাথ তলাকে ‘মুজিবনগর’ নামকরণ করে রাজধানী ঘোষণা করা হয় এবং জারি করা হয় ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’ তথা ‘Proclamation of Independence’। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে বঙ্গবন্ধু কর্তৃক ঘোষিত স্বাধীনতার ঘোষণাকে অনুমোদন করা হয়। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে আরও যা ঘোষিত হয় তন্মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ‘সংবিধান প্রণীত না হওয়া পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপ্রধান এবং সৈয়দ নজরুল ইসলাম উপ-রাষ্ট্রপ্রধান পদে অধিষ্ঠিত থাকিবেন এবং রাষ্ট্রপ্রধান প্রজাতন্ত্রের সশস্ত্র বাহিনীসমূহের সর্বাধিনায়ক পদে অধিষ্ঠিত থাকিবেন।’

রাষ্ট্রপতি শাসিত এই ব্যবস্থায় ‘ক্ষমা প্রদর্শনের ক্ষমতাসহ সর্বপ্রকার প্রশাসনিক ও আইন প্রণয়নের ক্ষমতা’, ‘একজন প্রধানমন্ত্রী এবং প্রয়োজন মনে করলে মন্ত্রিসভার সদস্যদের নিয়োগের’ ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির হাতে ন্যস্ত করার বিধান রাখা হয়। এছাড়াও যেহেতু বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী, সেহেতু স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে এই মর্মে বিধান রাখা হয় যে, ‘কোনো কারণে যদি রাষ্ট্রপ্রধান না থাকেন অথবা যদি রাষ্ট্রপ্রধান কাজে যোগদান করিতে না পারেন অথবা তাহার দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে অক্ষম হন, তবে রাষ্ট্রপ্রধান প্রদত্ত সকল ক্ষমতা ও দায়িত্ব উপ-রাষ্ট্রপ্রধান পালন করিবেন।’

‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’ মোতাবেক উপ-রাষ্ট্রপ্রধান সৈয়দ নজরুল ইসলাম ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপ্রধানের দায়িত্ব পালন করেন এবং জাতীয় নেতা তাজউদ্দীন আহমদ প্রধানমন্ত্রী, জাতীয় নেতা ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী অর্থমন্ত্রী, জাতীয় নেতা এএইচএম কামারুজ্জামান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দান করেন। পরে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে মন্ত্রিপরিষদের সভায় কর্নেল ওসমানীকে প্রধান সেনাপতি নিয়োগ করা হয়। ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’-এই সাংবিধানিক দলিলটির মহত্তর বৈশিষ্ট্য হচ্ছে আমরা ‘বাংলাদেশ গণপরিষদ’ সদস্যগণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলাম, ‘আমাদের এই স্বাধীনতার ঘোষণা ১৯৭১ সালের ছাব্বিশে মার্চ হইতে কার্যকর বলিয়া গণ্য হইবে।’ অর্থাৎ যেদিন বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা প্রদান করেছিলেন সেই দিন থেকে কার্যকর হয়। জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা অনুসারে প্রণীত ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’ মোতাবেক স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা ও সরকারের শপথ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় সতেরোই এপ্রিল ঐতিহাসিক মুজিবনগরে।

তাজউদ্দীন ভাইয়ের সাথে আমি সীমান্ত অঞ্চল পরিদর্শন করেছি। একটি বিশেষ প্লেনে তাজউদ্দীন ভাই, ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম, মণি ভাই এবং আমি যখন শিলিগুড়ি পৌঁছাই, তখন ওখানে পূর্বাহ্নে ধারণকৃত তাজউদ্দীন ভাইয়ের বেতার ভাষণ শুনলাম। বাংলার মানুষ তখন মুক্তিযুদ্ধের প্রশ্নে আপোষহীন, এক কাতারে দণ্ডায়মান। পরে ১৭ এপ্রিল যেদিন বাংলাদেশের প্রথম সরকারের শপথ গ্রহণের তারিখ নির্ধারিত হয়, তার আগে ষোলোই এপ্রিল গভীর রাতে-মণি ভাই, সিরাজ ভাই, রাজ্জাক ভাই এবং আমি-আমরা মুজিব বাহিনীর চার প্রধান, একটা গাড়িতে করে রাত তিনটায় নবগঠিত সরকারের সফরসঙ্গী হিসেবে কলকাতা থেকে রওনা করি সীমান্ত সন্নিহিত মেহেরপুরের বৈদ্যনাথ তলা তথা স্বাধীন বাংলাদেশের রাজধানী মুজিবনগরের উদ্দেশে।

সূর্যোদয়ের সাথে সাথে প্রবেশ করি প্রিয় মাতৃভূমির মুক্তাঞ্চল মেহেরপুরের আম্রকাননে। আমাদের সঙ্গে দেশি-বিদেশি অনেক সাংবাদিক ছিলেন। কঠোর গোপনীয়তা রক্ষা করা হয়েছিল। আশঙ্কা ছিল পাকিস্তান বাহিনী সেখানে বোমা হামলা চালাতে পারে। মেহেরপুরসহ আশপাশের এলাকা থেকে প্রচুর লোকসমাগম হয়েছিল। মুহুর্মুহু ‘জয় বাংলা’ রণধ্বনিতে আকাশ-বাতাস তখন মুখরিত। আন্তর্জাতিক বিশ্ব বিস্ময়ের সাথে প্রত্যক্ষ করছিল নবীন এক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের উদ্ভব। দিনটি ছিল শনিবার। সকাল ১১টা ১০ মিনিটে পশ্চিম দিক থেকে শীর্ষ নেতৃবৃন্দ দৃপ্ত পদক্ষেপে মঞ্চের দিকে এলেন। দেশ স্বাধীন করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ সমবেত সংগ্রামী জনতা গগনবিদারী স্বরে ‘জয়বাংলা’ জয়ধ্বনি দিলো।

মুজিবনগরে শপথ অনুষ্ঠান স্থলে একটি ছোট্ট মঞ্চ স্থাপন করা হয়েছিল। ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপ্রধান সৈয়দ নজরুল ইসলাম প্রথমে মঞ্চে আরোহন করেন। ঝিনাইদহের এসডিপিও মাহবুবউদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি সশস্ত্র দল রাষ্ট্রপ্রধানকে ‘গার্ড অব অনার’ প্রদান করেন। এরপর মঞ্চে আসেন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, মন্ত্রিপরিষদ সদস্যবৃন্দ এবং প্রধান সেনাপতি কর্নেল ওসমানী। উপস্থিত স্বেচ্ছাসেবকগণ পুষ্পবৃষ্টি নিক্ষেপ করে নেতৃবৃন্দকে প্রাণঢালা অভ্যর্থনা জ্ঞাপন করেন। সরকারের মুখপত্র ‘জয়বাংলা’ পত্রিকার সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি আবদুল মান্নান, এমসিএ’র (Member of Constituent Assembly) উপস্থাপনায় শপথ অনুষ্ঠান আরম্ভ হয়। প্রথমেই নতুন রাষ্ট্রের ঐতিহাসিক দলিল ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’ পাঠ করেন চিফ হুইপ অধ্যাপক ইউসুফ আলী। পবিত্র ধর্মগ্রন্থ থেকে পাঠ করা হয়।

আকাশে তখন থোকা থোকা মেঘ। স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলনের সাথে সাথে বাংলা মায়ের চারজন বীরসন্তান প্রাণ ঢেলে গাইলেন জাতীয় সঙ্গীত ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’। উপস্থিত সকলেই তাদের সাথে কণ্ঠ মিলালাম। অপূর্ব এক ভাবগম্ভীর পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছিল তখন। ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপ্রধান সৈয়দ নজরুল ইসলাম ইংরেজিতে প্রদত্ত ভাষণের শুরুতে বলেন, ‘ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি হিসেবে আমি তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী পদে নিয়োগ করেছি এবং তার পরামর্শক্রমে আরও তিনজনকে মন্ত্রীরূপে নিয়োগ করেছি।’ এরপর তিনি প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিপরিষদ সদস্যবৃন্দকে পরিচয় করিয়ে দেন। তারপর ঘোষণা করেন প্রধান সেনাপতি পদে কর্নেল ওসমানী এবং সেনাবাহিনীর চীফ অব স্টাফ পদে কর্নেল আবদুর রবের নাম। ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপ্রধান সৈয়দ নজরুল ইসলাম তার আবেগময় ভাষণের শেষে দৃপ্তকণ্ঠে আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, ‘আমাদের রাষ্ট্রপতি জনগণ নন্দিত ক্ষণজন্মা মহাপুরুষ নির্যাতিত মানুষের মূর্ত প্রতীক শেখ মুজিব বাংলার মানুষের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অধিকারের জন্য সংগ্রাম করে আজ বন্দী। তার নেতৃত্বে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম জয়ী হবেই।’ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণের পর তাজউদ্দীন আহমদ অভূতপূর্ব ও অবিস্মরণীয় বক্তৃতায় বলেন, ‘পাকিস্তান আজ মৃত এবং অসংখ্য আদম সন্তানের লাশের তলায় তার কবর রচিত হয়েছে। পূর্ব পরিকল্পিত গণহত্যায় মত্ত হয়ে ওঠার আগে ইয়াহিয়ার ভাবা উচিত ছিল তিনি নিজেই পাকিস্তানের কবর রচনা করছেন।’ মুক্তিযুদ্ধের সার্বিক পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে বক্তৃতার শেষে তিনি বলেন, ‘আমাদের এই অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামে আমরা কামনা করি বিশ্বের প্রতিটি ছোট বড়ো জাতির বন্ধুত্ব। বিশ্ববাসীর কাছে আমরা আমাদের বক্তব্য পেশ করলাম। বিশ্বের আর কোনো জাতি আমাদের চেয়ে স্বীকৃতির বেশি দাবিদার হতে পারে না। কেননা, আর কোনো জাতি আমাদের চেয়ে কঠোরতর সংগ্রাম করেনি, অধিকতর সংগ্রাম করেনি। জয়বাংলা।’ ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপ্রধান ও প্রধানমন্ত্রী উভয়েই তৎকালীন বাস্তবতায় যা বলার প্রয়োজন ছিল তা-ই তারা বলেছেন। আমাদের শীর্ষ দুই নেতার এই দিক-নির্দেশনামূলক ভাষণ ছিল ঐতিহাসিক এবং অনন্য। জাতীয় নেতৃবৃন্দ, নির্বাচিত এমসিএ, স্থানীয় জনপ্রতিনিধিবৃন্দ, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, আন্তর্জাতিক ও জাতীয় খ্যাতিসম্পন্ন সাংবাদিকগণ, পাবনার জেলা প্রশাসক জনাব নুরুল কাদের খান, মেহেরপুরের মহকুমা প্রশাসক জনাব তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরীসহ আরও অনেকেই সেখানে উপস্থিত ছিলেন।

নিয়মতান্ত্রিকতার মধ্য দিয়ে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে প্রতিনিধিদের ইচ্ছার শতভাগ প্রতিফলন ঘটিয়ে সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা অক্ষুণ্ণ রেখে, রাজনৈতিক বৈধতা অর্জন করে সেদিন রাষ্ট্র ও সরকার গঠিত হয়েছিল। আর এসব কিছুর বৈধ ভিত্তি ছিল বঙ্গবন্ধু প্রদত্ত ‘স্বাধীনতার ঘোষণা’। মুক্তিযুদ্ধের সূচনালগ্নে তথা ’৭১-এর এপ্রিলের ১০ ও ১৭ তারিখে প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্র ও সরকারের প্রধানতম লক্ষ্য ছিল সাংবিধানিকভাবে রাজনৈতিক বৈধতা নিশ্চিত করে সমগ্র বিশ্বের সমর্থন নিয়ে জনযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশকে শত্রুমুক্ত করে সুমহান বিজয় ছিনিয়ে আনা। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে দেরাদুনে মুজিব বাহিনীর ট্রেনিং ক্যাম্পে শপথের সময় আমরা সমস্বরে বলতাম, ‘বঙ্গবন্ধু মুজিব, তুমি কোথায় আছ, কেমন আছ আমরা জানি না। কিন্তু যতদিন আমরা প্রিয় মাতৃভূমি এবং তোমাকে মুক্ত করতে না পারবো, ততদিন আমরা মায়ের কোলে ফিরে যাবো না।’ মুক্তিযুদ্ধের রক্তক্ষয়ী দিনগুলোতে বাঙালির চেতনায় বন্দী মুজিব মুক্ত মুজিবের চেয়ে বেশি শক্তিশালী ছিলেন। যারা ষড়যন্ত্রকারী তাদের হোতা খুনি মুশতাক তখনই আমাদের কাছে প্রশ্ন তুলেছিল, ‘জীবিত মুজিবকে চাও, না স্বাধীনতা চাও।’ আমরা বলতাম, ‘আমরা দু’টোই চাই। স্বাধীনতাও চাই, বঙ্গবন্ধুকেও চাই।’ ত্রিশ লক্ষ প্রাণ আর দু’লক্ষ মা-বোনের আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে আমরা বাংলার স্বাধীনতা এবং বঙ্গবন্ধু মুজিবকে মুক্ত করতে পেরেছিলাম।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী ও মহান স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে আজ বঙ্গবন্ধুসহ জাতীয় চার নেতা- সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী ও এএইচএম কামারুজ্জামানের অমর স্মৃতি গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করি। জাতীয় চার নেতা জীবনে-মরণে বঙ্গবন্ধুর পাশে থেকেছেন। কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে থেকেছেন, মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছেন, কিন্তু বেঈমানি করেননি। ইতিহাসের পাতায় তাদের অবদান স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। প্রিয় মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য তারা যে আত্মদান করেছেন সেই আত্মদানের ফসল স্বাধীন বাংলাদেশ। জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসে জাতীয় নেতৃবৃন্দের বীরত্বপূর্ণ অবদানের কথা সর্বত্র স্মরণ করা উচিত।

আজ বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ উন্নয়নের রোল মডেল। মহান স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও মুজিববর্ষের অনুষ্ঠানমালায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানগণ এসেছেন, তাতে দেশের গৌরব বৃদ্ধি পেয়েছে। জাতীয় ইতিহাসের গৌরবময় দিনগুলো স্মরণ করে জাতীয় মর্যাদা ও গৌরব বৃদ্ধিই হোক আমাদের অঙ্গীকার।

তোফায়েল আহমেদ

আওয়ামী লীগ নেতা; সংসদ সদস্য; সভাপতি, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি

[email protected]



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


জনপ্রিয় খবর